তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ
গুলশান ও ধানমন্ডির চারটি রেস্তোরাঁ এবং কক্সবাজারের দুটি পাঁচ তারকা হোটেলে প্রকাশ্যে বিএটির প্রচারণাসামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে। আইন অনুযায়ী লিফলেট, পোস্টার, বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ডসহ যেকোনো উপায়ে তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ সত্ত্বেও বিএটি তাদের প্রচারণামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে। ছবি: স্টার

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে দেশের বড় শহরগুলোর অভিজাত রেস্তোরাঁ ও হোটেলে নিয়ন্ত্রিত পণ্য সিগারেট বিক্রিতে উৎসাহ দিচ্ছে।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই তামাক কোম্পানিটি গোপনে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মতো বড় শহরের বিলাসবহুল হোটেল ও রেস্তোরাঁর সঙ্গে অংশীদারত্ব করে তাদের সিগারেট ও প্রচারণামূলক সামগ্রী সরবরাহ করছে।

কিছু ক্ষেত্রে বিএটি চুক্তির অংশ হিসেবে ওই রেস্তোরাঁগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, যার ফলে সেই রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার ও সিগারেট বিক্রি বেড়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ছয়টি রেস্তোরাঁ মালিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, তামাক কোম্পানিটির প্রচারণাসামগ্রী প্রদর্শনের জন্য রেস্তোরাঁ মালিকদের সঙ্গে তাদের 'আর্থিক চুক্তি' রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলায় দ্য ডেইলি স্টার ওই রেস্তোরাঁ ও হোটেলগুলোর নাম প্রকাশ করেনি।

ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে গত বছর ভয়েস বাংলাদেশ নামে একটি এনজিওর প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের সামঞ্জস্যতা আছে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ১০২টি রেস্টুরেন্টের ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে করা গবেষণায় দেখা গেছে, বিএটি তাদের পণ্য বিক্রি ও প্রচারণাসামগ্রী প্রদর্শনের জন্য এসব রেস্তোরাঁয় বিনিয়োগ করেছে।

সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, এসব রেস্তোরাঁগুলো প্রচারণাসামগ্রী প্রদর্শনের জন্য বিএটি থেকে এককালীন নগদ সুবিধা পেয়েছে। ভাড়া বা ইউটিলিটি বিল মেটানোর উদ্দেশ্যে চেক বা ট্রান্সফারের মাধ্যমে এক লাখ ২০ হাজার থেকে ৫৪ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়।

গত ১০ দিনে একাধিক বার ফোন করে এবং ক্ষুদেবার্তা ও ইমেল পাঠিয়ে ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য জানানো হলেও বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি বিএটি।

হোটেল ও মাল্টিরুম রেস্টুরেন্টে ধূমপানের জন্য আলাদা জায়গা রাখা বৈধ। কিন্তু ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) লিফলেট, পোস্টার, বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ডসহ যেকোনো উপায়ে তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করেছে।

এই আইনে ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করার জন্য বিনামূল্যে নমুনা বা কম টাকায় পণ্যের প্রস্তাব দেওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আইন লঙ্ঘন করলে তিন মাসের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। পুনরায় একই অপরাধ করলে পরবর্তী সময়ে নিয়ম ভঙ্গের জন্য দ্বিগুণ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

বিধিনিষেধ ও শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ ও হোটেলে এ ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে বিএটি।

গত দুই সপ্তাহে ডেইলি স্টার রাজধানীর ধানমন্ডি, বনানী ও গুলশানের ১৮টি রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখেছে, ১৫টিতে আলাদা স্মোকিং জোন রয়েছে, যেখানে শুধু বিএটির ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়।

গুলশানের দুটি ও ধানমন্ডির একটি রেস্তোরাঁয় বিএটির সিগারেট ও তাদের লোগোসম্বলিত লাইটারসহ তাদের পণ্যগুলো প্রকাশ্যেই রাখা ছিল।

এই তিনটি রেস্টুরেন্টের স্মোকিং জোনে চোখ ধাঁধানো ডিসপ্লে ও বিজ্ঞাপন দেখা যায়। প্রতিটি টেবিলে একটি করে ডিসপ্লে কেস ছিল এবং বড় বড় শোকেসে সিগারেটের বিজ্ঞাপন ছিল।

গুলশানের একটি রেস্তোরাঁর মেন্যুতে 'টোব্যাকো' বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে ৩২৫ টাকা দামের চারটি ব্র্যান্ডের বিএটি সিগারেটের তালিকা রয়েছে, যদিও বেশিরভাগ খুচরা দোকানে এর দাম আরও বেশি নেওয়া হয়।

বিক্রি বাড়ানোর জন্য বিপণন কৌশলের দিকে ইঙ্গিত করে ওই রেস্তোরাঁর এক কর্মী বলেন, 'আমরা শুধু বিএটি পণ্য বিক্রি করি। খুচরো বিক্রি করি না, পুরো প্যাকেট কিনতে হয়।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেস্তোরাঁ মালিক বলেন, বিএটির প্রচারণামূলক কার্যক্রম তার জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক।

'বিএটির সঙ্গে চুক্তি করা লাভজনক। কারণ তারা প্রতি মাসেই আমার রেস্তোরাঁয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওই দিনগুলোতে বাড়তি বিক্রি থেকে ভালো মুনাফা হয়', বলেন তিনি।

ওই রেস্তোরাঁ মালিক আরও বলেন, বিএটি কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে তদারকি করেন যাতে তাদের প্রচারণাসামগ্রী যথাযথভাবে প্রদর্শিত হয়।

ভয়েস বাংলাদেশও তাদের গবেষণায় একই তথ্য পেয়েছে।

গুলশানের একটি কফি শপের ম্যানেজার বিএটির সঙ্গে 'গোপন' আর্থিক চুক্তির কথা স্বীকার করেছেন। ওই চুক্তির কারণে ২০২১ সাল থেকে তার ক্যাফেতে বিএটি প্রচারণা চালাচ্ছে।

গুলশান ও বনানীর রেস্তোরাঁ মালিকরা জানান, এই দুই অভিজাত এলাকায় অন্তত ২০টি রেস্তোরাঁর সঙ্গে বিএটির প্রচারণা-বিষয়ক চুক্তি আছে।

চট্টগ্রামের দুই রেস্তোরাঁ মালিক জানান, বিএটির প্রচারণাসামগ্রী প্রদর্শনের জন্য তাদের সঙ্গে মৌখিক চুক্তি হয়েছে এবং চুক্তির অংশ হিসেবে তারা প্রতি মাসে কিছু অর্থ পেতেন। তবে প্রায় এক বছর ধরে বিএটি থেকে তারা কোনো টাকা পাচ্ছেন না।

কক্সবাজারের অন্তত দুটি পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে বিএটির প্রচারণাসামগ্রী প্রদর্শিত হয়।

এই দুটি হোটেলের একটির কর্মকর্তা বিএটি তাদের সিগারেট ও প্রচারণাসামগ্রী সরবরাহ করে বলে স্বীকার করেছেন। তবে তামাক কোম্পানিটির সঙ্গে কোনো ধরনের আর্থিক চুক্তির বিষয়ে তিনি অবগত নন বলে জানান।

অন্য পাঁচ তারকা হোটেলের একজন কর্মকর্তা ডেইলি স্টারের ফোন ও ক্ষুদেবার্তার জবাব দেননি।

বিষয়টি নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার শাহাদাত হোসেনের কাছে প্রশ্ন পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।

কিছু জানেন না বলে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী রোকেয়া সুলতানাও।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

6h ago