বর্ষায় কাপড়ের স্যাঁতসেঁতে ভাব ও দুর্গন্ধ দূর করার উপায়

বর্ষায় কাপড়ের যত্ন
ছবি: সংগৃহীত

বর্ষাকাল মানেই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে স্বস্তি। দিনভর রোদের প্রখর তাপ থেকে মুক্তি দিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি সারা শরীর জুড়ে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। কিন্তু নিত্যদিনের স্বাস্থ্যকর পোশাক-পরিচ্ছদের প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন এই ভেজা আবহাওয়াটাই হয়ে ওঠে বিড়ম্বনার কারণ।

ভালো করে ধুয়ে শুকানোর পরেও নতুন জামা-কাপড়ে লেগে থাকা অপ্রীতিকর গন্ধ এ সময় স্বাভাবিক বিষয়। দুর্গন্ধের পাশাপাশি কাপড়ের স্যাঁতসেঁতে ভাব রীতিমতো বিরক্তির উদ্রেক করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চলুন বৃষ্টির মৌসুমে জামা-কাপড়ের দুর্গন্ধের কারণ এবং তা দূর করার ঘরোয়া উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।

বর্ষাকালে কাপড়ের স্যাঁতসেঁতে ভাব ও দুর্গন্ধের কারণ

বাতাসে আর্দ্রতার আধিক্য

বৃষ্টির দিনগুলোতে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যায়। এই উচ্চ আর্দ্রতা বাষ্পীভবন প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। ফলশ্রুতিতে জামা-কাপড় পরিপূর্ণভাবে শুকাতে অনেক সময় লেগে যায়। বৃষ্টির কারণে চারপাশের  স্যাঁতসেঁতে অবস্থার প্রভাব পড়ে কাপড়ের উপর। এমনকি এই আর্দ্রতা ড্রয়ারে রাখা কাপড়গুলোকেও স্যাঁতসেঁতে করে তোলে।

কাপড়ের মধ্যে বিশেষ করে তুলা এবং উলের মতো প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি পোশাকগুলো বাতাস থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে। ফলে প্রথম দিকে সাময়িক শুষ্কতা থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই কাপড়গুলোতে স্যাঁতসেঁতে ভাব চলে আসে।

কাপড় শুকানোর পর্যাপ্ত পরিবেশের অভাব

সূর্যের তাপ ও অতিবেগুনি রশ্মি উভয়ই বাষ্পীভবন এবং ব্যাকটেরিয়া নষ্ট করতে সহায়তা করে। তাই কাপড় সঠিকভাবে শুকানোর ক্ষেত্রে সূর্যালোকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বর্ষাকালে অধিকাংশ সময় মেঘলা অবস্থা থাকার কারণে সরাসরি সূর্যালোক পাওয়া সম্ভব হয় না। এর ফলে কাপড়ে পরিপূর্ণ শুষ্কতা আসতেও অনেক সময় লাগে।

বর্ষাকালে বৃষ্টির কারণে অনেক সময় বারান্দাতেও কাপড় মেলে দেওয়ার উপায় থাকে না। এ অবস্থায় কাপড় শুকানোর একমাত্র অবলম্বন ভেতরের ঘরগুলো। ঘরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বায়ুচলাচলের অভাব থাকে। তাছাড়া দিনভর বৃষ্টি ঘরগুলোকে আগে থেকেই স্যাঁতসেঁতে করে রাখে, যে পরিবেশ কাপড় শুকানোর জন্য একদমই অনুকূল নয়।

জীবাণুর বংশবিস্তার ও সংক্রমণ

দীর্ঘ সময় ধরে স্তূপ করে বা দড়িতে মেলে রাখা কাপড় ব্যাকটেরিয়ার বংশবিস্তারের জন্য আদর্শ জায়গা। এই অণুজীবগুলো আর্দ্র অবস্থায় দ্রুত বংশবিস্তার এবং সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এর ফলে শুধু খারাপ গন্ধই নয়, নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও সৃষ্টি হয়। সম্পূর্ণভাবে শুকানোর আগেই যারা কাপড় পড়ে নেন তাদের এই ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

বর্ষাকালে বৃষ্টি ও তার পরের কিছু সময় বাদে অন্যান্য সময়গুলোতে গরম থাকে। এর সঙ্গে উচ্চ আর্দ্রতা সম্পন্ন বাতাস যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে ঘামের। আর ঘর্মাক্ত শরীরে যেখানে শুকনো কাপড়ই বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে, সেখানে হালকা ভেজা পরিধেয়গুলো রীতিমতো অসহনীয়।

তাছাড়া এই ঘাম কাপড়ের স্যাঁতসেঁতে অবস্থা বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের দূষকের জন্য অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করে।

ঘরোয়া উপায়ে বর্ষাকালে কাপড়ের স্যাঁতসেঁতে ভাব ও দুর্গন্ধ দূর করার পদ্ধতি

ধোয়ার জন্য কাপড় স্তূপ করে না রাখা

অনেকেই তাদের দৈনন্দিন কাপড় ধোয়ার জন্য সব একসঙ্গে করে একটি লন্ড্রি ব্যাগে বা ঝুড়িতে ফেলে রাখেন। বদ্ধ জায়গায় এভাবে কাপড় ফেলে রাখলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্গন্ধ আরও প্রকট আকার ধারণ করে। বর্ষা মৌসুমে এই কাপড়গুলো ধুয়ে ফেলার পরেও দুর্গন্ধ দূর হয় না।

মূলত জামা-কাপড়ের সঙ্গে লেগে থাকা ঘামসহ অন্যান্য শারীরিক তরল পদার্থ প্রতিটি পোশাকেই দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। যত বেশি পোশাক একসঙ্গে এক জায়গায় জমা করা হয়, সব পোশাকের গন্ধ মিলে দুর্গন্ধ আরও খারাপ হতে থাকে।

তাই জামা-কাপড়গুলোকে পরস্পরের মাঝে অল্প জায়গা রেখে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা উচিত। এমনকি কাপড়গুলো যদি কয়েক দিন পরে ধোয়ার জন্য রাখা হয়, তাহলেও সেগুলোকে আলাদাভাবে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। এতে করে কাপড়ের ভেতরে ও বাইরে উভয় অংশে কিছুটা বাতাস পায়, যা সেগুলোকে খারাপ গন্ধ থেকে দূরে রাখে।

নিয়মিত কাপড় ধোয়া

বৃষ্টির কারণে কাপড় শুকানোর পর্যাপ্ত উপায় না থাকার কারণে অনেকেই কাপড় ধোয়ার জন্য রোদ ওঠার অপেক্ষা করেন। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে দিনের পর দিন রোদের দেখা না পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। তাই পরিধেয় পোশাক পরিষ্কারের ক্ষেত্রে এই দীর্ঘ বিরতিটা একদমই উচিত নয়। বরং স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকার চেয়ে পরিষ্কার অবস্থায় হালকা ভেজা থাকা ভালো। একইভাবে ধুয়ে মেলে রাখার পর হালকা ভেজা কাপড়ের গন্ধের তুলনায় স্তূপ করে রাখা নোংরা কাপড়ের গন্ধ অনেক খারাপ। প্রতিদিন নিয়মিত পরিধেয়গুলো ধুয়ে ফেলা বৃষ্টির মৌসুমে অপ্রীতিকর গন্ধ অপসারণে অনেকটা সহায়ক হয়।

ভিনেগার, বেকিং সোডা বা লেবুর রস ব্যবহার করা

প্রতিদিন কাপড় ধোয়ার মাধ্যমে সতেজ গন্ধ দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু ওয়াশিং পাউডার যথেষ্ট নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডিটারজেন্টের সঙ্গে পানিতে কিছুটা ভিনেগার বা বেকিং সোডা মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এটি খারাপ গন্ধকে দূর করে কাপড়ের সুগন্ধ নিশ্চিত করতে পারে।

বেকিং সোডায় কাপড় ভিজিয়ে রাখলে তা ডিওডোরাইজার বা দুর্গন্ধনাশকের কাজ করে। জামা-কাপড় থেকে দুর্গন্ধ দূর করার পাশাপাশি এটি কাপড়কে নমনীয় করতে সাহায্য করে। এর জন্য ধোয়ার সময় প্রায় আধা কাপ বেকিং সোডাই যথেষ্ট।

আর ভিনেগার ডিটারজেন্টে থাকা দস্তার লবণ পৃথক করে কাপড়ে লেগে থাকা ময়লা দূর করে। ভিনেগারের ব্যাকটেরিয়া-বিরোধী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে।

ভিনেগার এবং বেকিং সোডা উভয়ই কাপড়ে তাদের নিজস্ব কোনো গন্ধ ছড়ায় না। ফলে কাপড় গন্ধহীন, পরিষ্কার এবং রীতিমতো তাজা হয়ে ওঠে।

হাতের কাছে কোনো কিছু না থাকলে নিদেনপক্ষে লেবুর রস দিয়েও কাপড়ের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ দূর করা যায়। এর জন্য জামা-কাপড় ভিজিয়ে রাখা পানিতে অল্প পরিমাণে লেবুর রস মিশিয়ে নিতে হবে।

ঘরের ভেতরে কাপড় শুকানোর সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা

সূর্যের প্রাকৃতিক অতিবেগুনী রশ্মি কাপড়ের অপ্রীতিকর গন্ধ থেকে মুক্তির জন্য সবেচেয়ে ভালো উপায়। বর্ষাকালের যে দিনগুলোতে রোদের দেখা মিলবে সে সময় বারান্দা, ছাদ বা উঠোনই কাপড় মেলে দেওয়ার উপযুক্ত স্থান। কিন্তু অন্যান্য দিনগুলোতে কাপড়গুলোর সর্বোচ্চ শুষ্কতা নিশ্চিতকরণে ঘরের ভেতরে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

কারণ ঘরের বাইরে ভেজা কাপড়গুলো উচ্চ আর্দ্রতার বাতাসের সর্বাধিক সংস্পর্শ পাবে। সেদিক থেকে ঘরের ভেতরটা সেই ক্ষতিকর আর্দ্রতা থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকে। তাই জামা-কাপড় জানালার ধারে উপরে বা ফ্যানের কাছাকাছি কোথাও ঝুলিয়ে রাখা যেতে পারে।

এর জন্য অনেকেই ঘরের ভেতরে দড়ি টাঙিয়ে কাপড়গুলো চলন্ত ফ্যানের নিচে ঝুলিয়ে রাখেন। এটি বেশ ভালো একটি উপায়। তবে এ ক্ষেত্রে যে ঘরটিতে বেশ ভালো বায়ু চলাচল রয়েছে, সে ঘরকে দড়ি টাঙানোর জন্য বেছে নেওয়া উচিত। এতে করে কাপড় শুকানোর প্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত দ্রুত হতে পারে।

শুকনো কাপড়ের জন্য শুকনো জায়গা নিশ্চিত করা

ওয়ারড্রোব বা ড্রেসারে দীর্ঘদিন বাদে পরিধানের জন্য নির্ধারিত পোশাকগুলো সুন্দরভাবে ভাঁজ করে রাখা হয়। কিন্তু দৈনন্দিন পরিধানের কাপড়গুলো সাধারণত বাইরে হ্যাঙ্গার বা আলনাতেই থাকে। এগুলো খুব দ্রুত আর্দ্রতাপূর্ণ বাতাসের সান্নিধ্যে আসে। এ ক্ষেত্রে কাপড়গুলো একটার ওপর আরেকটা না রেখে আলাদাভাবে দুয়েক ভাঁজ দিয়ে পরিপাটি করে রাখা উচিত। সম্ভব হলে প্রতিদিনের কাপড়গুলোর জন্যও আলাদা ওয়ারড্রোব রাখার চেষ্টা করা উচিত।

তাছাড়া অত্যধিক আর্দ্র আবহাওয়ার দিনগুলোতে ওয়ারড্রোবই আর্দ্রতা থেকে নিরাপদ থাকে না। এ অবস্থায় আর্দ্রতা শোষণ করার জন্য ড্রেসারে সিলিকন পাউচ, চক বা বেকিং সোডাসহ একটি ছোট কাপ রাখা যায়। এগুলো ডিহিউমিডিফায়ার বা আর্দ্রতা শোষক হিসেবে কাপড় থেকে দুর্গন্ধ দূর করতে সাহায্য করবে।

বর্ষাকালে জামা-কাপড়ের দুর্গন্ধের মূল কারণ হলো বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকা। এর ভিত্তিতেই পরবর্তীতে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা; অতঃপর জীবাণুর বংশবিস্তারের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় দুর্গন্ধ। এই আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হলে কাপড় শুকনো রাখার কোনো বিকল্প নেই। দুর্গন্ধ দূরীকরণে  ভিনেগার, বেকিং সোডা এবং লেবুর রস উপযুক্ত উপকরণ।

এরপরেও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের স্বার্থে ধোয়ার আগে বা পরে কখনই কাপড় অবিন্যস্তভাবে স্তূপ করে রাখা যাবে না। প্রতিদিন কাপড় পরিষ্কার এবং তা সঠিকভাবে শুকানোর এই পদ্ধতিগুলো অনুসরণের মাধ্যমে বৃষ্টির দিনগুলোতে জামা-কাপড়ের দুর্গন্ধজনিত বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি মিলবে।

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

6h ago