আমরা যে আধুনিকতায় মানুষ হয়েছি

লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৯ জুন শিশু একাডেমি মিলনায়তনে (ফিরে দেখা) একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় উঠে আসে তার মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ ও স্মৃতি, শৈশবের দিনগুলো। সবমিলিয়ে তার বক্তৃতাটি যেন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশ।

আত্মজৈবনিক বক্তৃতার কথাগুলো পাঁচ পর্বে প্রকাশিত হবে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। দীর্ঘ বক্তৃতাটি অনুলিখন করেছেন মোস্তফা মুশফিক ও ইমরান মাহফুজ। আজ প্রকাশিত হচ্ছে চতুর্থ পর্ব।

আমরা এখন খুব আধুনিকতার কথা বলছি। আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করছি, রেনেসাঁর কথা বলি। আমরা মনে করেছিলাম পাকিস্তান যখন হলো তখন রেনেসাঁ এসে গেল। রেনেসাঁ আসেনি। যখন বাংলাদেশ হলো তখন তো মনেই হলো রেনেসাঁ এসে গেছে। সমাজের পরিবর্তন ঘটবে, স্বাভাবিক রূপান্তর ঘটবে। সেই রকম কিছু ঘটল না। কিন্তু আধুনিকতার নানান ছাপ আমরা দেখেছি।

যেমন ধরুন, আমাদের নৃবিজ্ঞানী ঠাট্টা করে বলা হচ্ছে। ঠাট্টাগুলো তখন প্রচলিত ছিল, যে নৃবিজ্ঞান বিভাগটা কোথায়? বলছেন—'যদি যাও ওদিক দিয়ে তাহলে পারফিউমের গন্ধ পাবে। বুঝবে ওটাই নৃবিজ্ঞান।' নৃবিজ্ঞানে তখন ছেলেদের সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া খুব কঠিন। ফার্স্ট ক্লাস তো দূরের কথা! আমাদের শিক্ষকরা এ রকম একটা ভীতির সঞ্চার করেছিল তখন, যদি কোনো মেয়েকে জিজ্ঞেস করো কোন ক্লাস পেয়েছ, তখন সে ঘাড় উঁচু করে বলবে, 'সার্টেনলি নট সেকেন্ড ক্লাস!' অর্থ হচ্ছে, সে থার্ড ক্লাস পেয়েছে। কিন্তু সে বলছে যে সে সেকেন্ড ক্লাস পায়নি। আধুনিকতা আমরা ওই সময় দেখেছিলাম, এই আধুনিকতা ভেঙে পড়েছে।

এই আধুনিকতা এ রকম আমাদের দেশে এবং আমি একটা দৃষ্টান্ত দিতে চাই দুজন মানুষের কথা উল্লেখ করে। সেই দুজন মানুষের মধ্য থেকেই আমরা দেখব কোনটা আধুনিক আর কোনটা আধুনিক নয়। এর একজন হচ্ছেন নীরদ সি চৌধুরী। উনি কিশোরগঞ্জ এলাকার লোক।

কিশোরগঞ্জ এলাকার আরেকজন মানুষ কেউ কেউ শুনেছেন, তিনি হারিয়ে গিয়েছেন, রেবতী মোহন বর্মণ। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা। তিনি আর এই নীরদ সি চৌধুরী। এরা পাশাপাশি গ্রামের মানুষ, দুজনের বাবা ওকালতি করতেন, দুজনেরই অবস্থান বেশ মধ্যবিত্ত। কিন্তু রেবতী মোহন বর্মণের নাম তো আমরা শুনি না। কারণ, রেবতী মোহন বর্মণকে তো আমরা আধুনিকও বলি না, বলি না এজন্য যে তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন।

রেবতী মোহন বর্মণ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। গ্রাম থেকে পড়তে এসেছিলেন ঢাকায়। ঢাকাতে তখন স্ত্রী সংঘ ছিল। স্ত্রী সংঘে লীলা নাগ-অনিল রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রী। লীলা নাগ খুবই মেধাবী ছিলেন। শুভ নব সুভা দলের লোক ছিলেন, জেল খেটেছেন। কিন্তু তারা ঘোরতর কমিউনিস্ট-বিরোধী। এটা আমরা খেয়াল করি না—নিলা নাগ স্কুল করেছেন, পত্রিকা বের করেছেন, সবই সত্য। অনিল রায় তার সহযোগী ছিলেন, সব সত্য। কিন্তু, ভীষণ কমিউনিস্ট-বিরোধী ছিলেন!

এখন রেবতী মোহন বর্মণ এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ছাত্রজীবনে তিনি বুঝে ফেলেছেন মার্ক্সিস্ট সাহিত্য, লিটারেচার কিছু পড়েছেন, বুঝে ফেলেছেন যে এই জাতীয়তাবাদের পথ আসল পথ নয়। তারপর কিন্তু তিনি যেহেতু তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সেজন্যে ইংরেজ সরকার তার ছাত্রত্বই নষ্ট করে দিয়েছে। তিনি তার গ্রামে ফিরে গেছেন। গ্রামে ফিরে স্বল্পকাল আগে প্রতিষ্ঠিত একটা স্কুলে, প্রায় অখ্যাত স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পরীক্ষা দিলেন। মেট্রিক পরীক্ষায় সারা বাংলায় তিনি প্রথম হলেন ওই স্কুল থেকে।

সারাবাংলা মানে তখন আসাম, তার অন্তর্গত উড়িষ্যা। এই এলাকার মধ্যে প্রথম হলেন। ইকোনোমিকস পড়ে তিনি গোল্ড মেডেল পেয়েছেন, গোল্ড মেডেল পেয়ে তিনি সেই টাকা ভাঙ্গিয়ে, সে টাকা দিয়ে কুলায়নি আর অন্য টাকা নিয়ে 'বেহু' নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেছেন। সেই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছিলেন। কলকাতায় পিটার্স স্টুয়ার্ট নামের একটি কুখ্যাত লোক ছিলেন, পুলিশের লোক। তাকে হত্যা করার একটা অভিযোগ হয়েছিল। প্রকাশ্যে হত্যার সেই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তিনি জেলে গেলেন। সেই জেলে তিনি আট বছর ছিলেন, আট বছর কারাগারে ছিলেন। সেই সময়টায় তিনি ওই যে তিনি মার্কসবাদীর কথা আগে জানতেন, সাহিত্য করেছেন, অনুবাদ করেছেন, বই লিখেছেন। তার লেখা বই 'সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি' সমাজবিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়েন।

তিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কী সেটা বুঝেছেন। এই অসাধারণ মানুষটি ৩৮ সালে বেরিয়ে এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে সরাসরি যোগ দিলেন। কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হলেন, ছাত্রদের শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হলেন। একে কিন্তু আমরা আধুনিক বলি না। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে যে তিনি তো বাংলায় লিখেছেন, মেহনতি মানুষ কথা লিখেছেন, তিনি তো কমিউনিস্ট ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী নিরদ সি চৌধুরীর বক্তব্য ছিল—ইংরেজরা আমাদের এ দেশে এসে উপকার করেছে এবং ইংরেজরা যখন চলে গেছে তখন আমেরিকানদের আসা উচিত ছিল। আমেরিকানরা এলে আমাদের আরও উপকার হবে, যেটা রামমোহন রায় বলতেন, তিনি বলতেন কলোনিয়ালিস্টরা এখানে এসে কেন বসতি স্থাপন করে না। যাই হোক, নিরদ চৌধুরী আধুনিক আর আমাদের এই বর্মণ, রেবতী বর্মণ, তিনি আধুনিক নন। এটি হচ্ছে প্রচার।

১৯৪৭ সালে স্বাধীন হলো। তখন বর্মণদের পরিবারের সবাই একে একে চলে গেলেন, বর্মণ একা রয়ে গেলেন। তিনি অসুস্থ হলেন। আগরতলায় গেলেন, সেখানে মারা গেলেন। মাত্র ৪৭ বছর বয়সের এই রেবতী বর্মণ, যার আয়ুষ্কাল নিরদ চৌধুরী আয়ুষ্কালের অর্ধেক, কিন্তু তাকে আধুনিক বলা হচ্ছে না। আধুনিকতা মানেই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে থাকা, পুঁজিবাদের সঙ্গে থাকা। সেই আধুনিকতাই হয়ে গেছে আধুনিকতা।

আমাদের বাংলা সাহিত্যে যে আধুনিকতার কথা আমরা জানি, সেটা হচ্ছে কলোনিয়াল আধুনিকতা। সেটা রেবতী বর্মণের আধুনিকতা নয়। রেবতী বর্মণ বই প্রকাশ করেছেন, লিখেছেন, আন্দোলন করেছেন। তাকে কেউ আধুনিক বলে না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের যে অনুচর, সাম্রাজ্যবাদের যে সহযোগী, নীরদ সি চৌধুরী, তাকে আধুনিক বলা হয়। এটা হচ্ছে আধুনিকতার বিষয়।

আধুনিকতার আরেকটা দিক আমি বলি। আমার বাবার বিশ্বাস ছিল মিশনারি স্কুলেই সবচাইতে ভালো পড়াশোনা হয়। কলকাতাতে তিনি আমাকে মিশনারি স্কুলে ভর্তি করালেন। ঢাকাতে এসেও মিশনারি হাই স্কুলে ভর্তি করাবেন এবং কলেজেও ওই মিশনারিতে ভর্তি করাবেন। আমাদের কলেজে মার্টিন নামে যিনি পড়াতেন, খুব ভালো তরুণ শিক্ষক। ২০ বছর বয়সে তিনি আমাদেরকে দিয়ে টেম্পেস্ট, শেক্সপিয়ারের মূল নাটক; সেখানে আমাকে ক্যালিবানের অভিনয় করিয়েছিলেন। ক্যালিবানের কবিতা ছিল, আমাদের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করছিল। একদিন ধরে যে নাটক হওয়ার কথা ছিল, সেটা দুইদিন ধরে হচ্ছিল। মার্টিন খুব ভালো পড়ান। রাষ্ট্র ভাগ আন্দোলন হয়েছিল, এর মধ্যে আমি পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড নিতে গেছি, মার্টিনের সঙ্গে দেখা। আমি খুব বিষণ্ণ রূপে ফাদার মার্টিনকে বললাম, 'আমাদের রবি স্যার তো অ্যারেস্ট হয়েছে'। ফাদার মার্টিন খুব কাছে এসে চুপিচুপি আমাকে বললেন, 'ডু ইউ নো হি ওয়াজ অ্যা কমিউনিস্ট?'

আমি খুব কেঁপে উঠলাম! তারা দুজন তো ভালো বন্ধু ছিলেন! তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, তাই জেলে গেছেন, ভালোই হয়েছে—তিনি বলছেন! এটা ছিল আধুনিকতার চরিত্র। যে আধুনিকতার মধ্যে সমাজতন্ত্র-বিরোধী, সেটা ছিল প্রবল এবং অত্যন্ত প্রবল এবং এই আধুনিকতার মধ্য দিয়ে আমরা মানুষ হয়েছি।

Comments

The Daily Star  | English

Central bank at odds with BPO over Nagad’s future

The discord became apparent after Faiz Ahmed Taiyeb, special assistant to the chief adviser with authority over the Ministry of Posts, Telecommunications and IT, sent a letter to the BB governor on May 12 and posted the letter to his Facebook account recently

5h ago