‘পানি লাগবে কারো, পানি?’—বুলেটে নিঃশেষ যে জীবন

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। ছবি: সংগৃহীত

'পানি লাগবে কারো, পানি, পানি?'

গত ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকায় মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ যখন পানির কেস হাতে নিয়ে ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে পানি বিতরণ করছিলেন, তখন তিনি ঠিক মতো তাকাতেও পারছিলেন না। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের ছোড়া টিয়ারগ্যাসে তার চোখ হয়তো জ্বালা করছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুগ্ধর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধর শেয়ার করা এক ভিডিওতে দেখা যায় সেদিন অকুতোভয় মুগ্ধ কীভাবে সেবা দিয়ে চলেছেন অন্য শিক্ষার্থীদের।

ভিডিওটা যে সময়ে করা হয়, তার মাত্র ১৫ মিনিট পর থেকেই তিনি আর কাউকে পানি দেননি, দিতে পারেননি। আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালালে একটি গুলি মুগ্ধর কপালে লাগে।

তার সঙ্গে থাকা বন্ধুরা দ্রুত মুগ্ধকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান তিনি।

ফেসবুকে প্রোফাইল ছবির ক্যাপশনে মুগ্ধ যা লিখেছিলেন, তার বাংলা অনেকটা এমন—জীবন অর্থবহ হোক, দীর্ঘ নয়।

সত্যিই এক অর্থবহ জীবনযাপন করে গেলেন মুগ্ধ।

তার বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত জানান, মুগ্ধ ১৮ জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন এবং সেখানে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সহায়তা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার্থীরা ন্যায়সঙ্গত লড়াই করছে।

ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব মুগ্ধ। তিনি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কাউট গ্রুপের একজন রোভার স্কাউট এবং ইউনিট লিডার ছিলেন। ২০১৯ সালে বনানী অগ্নিকাণ্ডের সময় উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ ও সাহসী ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ স্কাউটস থেকে 'ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড' অর্জন করেন মুগ্ধ।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে গত মার্চে এমবিএ করতে মুগ্ধ ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে।

স্নিগ্ধকে ফেলে গেলেন মুগ্ধ

চলমান আন্দোলনের শুরুর দিকে মুগ্ধর পরিবার ছুটি কাটাতে যায় কক্সবাজারে। কিন্তু, মুগ্ধ ও তার যমজ ভাই স্নিগ্ধ থেকে যান ঢাকাতেই।

মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একসঙ্গেই স্কুলে গিয়েছেন। তাদের বন্ধুও ছিল অভিন্ন।

মুগ্ধর মৃত্যুর পর থেকেই ট্রমায় আছেন স্নিগ্ধ। দ্য ডেইলি স্টার থেকে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, 'প্লিজ, আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন।'

তাদের বড় ভাই দীপ্ত বলেন, 'স্নিগ্ধ একেবারেই নিস্তেজ হয়ে গেছে।'

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্নিগ্ধই প্রথম দেখেছিলেন মুগ্ধর মরদেহ।

দীপ্ত বলেন, 'স্নিগ্ধর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি স্মৃতি মুগ্ধর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সে শুধু ভাই হারায়নি, হারিয়েছে নিজের জীবনের একটা অংশ।'

দীপ্ত জানান, ১৮ জুলাই সকালে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারে যান তারা।

'আমার মা কখনো সৈকত দেখেননি। গত বছর মুগ্ধ বাবা-মাকে প্রথমবারের মতো সুন্দরবনে নিয়ে গিয়েছিল। তাই, এবার আমি বাবা-মাকে কক্সবাজারে নিয়ে যাই,' বলেন তিনি।

কিন্তু তাদের সঙ্গী হননি মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ। দীপ্ত জানান, তারা দুটি কারণে যেতে চাননি। একটি হচ্ছে, ২০ জুলাই বন্ধুদের সঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার পরিকল্পনা এবং অপরটি, কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া।

১৮ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মুগ্ধর মৃত্যুর খবর পান দীপ্ত।

সেদিনই ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করলেও ফ্লাইট না থাকায় পারেননি। চলমান অস্থিরতার মাঝে সড়কপথে সময় বেশি লাগায় ১৯ জুলাই সকালের ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন তারা।

দীপ্ত বলছিলেন, 'মুগ্ধর মৃত্যুর খবর কীভাবে যে মাকে বলব বুঝতে পারছিলাম না। মা হার্টের রোগী। এটা নিয়েও চিন্তা ছিল।'

প্রথমে তিনি মা-বাবাকে জানান, মুগ্ধ সামান্য আহত হয়েছেন। পরে জানান তিনি হাসপাতালে আছেন, অবস্থা সংকটাপন্ন।

মুগ্ধর মৃত্যুর খবর জানার পর ভেঙে পড়েন তাদের মা। এখনও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি।

দীপ্ত বলেন, 'আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে মুগ্ধ মায়ের সবচেয়ে কাছের ছিল। তার মৃত্যুতে মায়ের পৃথিবীটাই যেন উজাড় হয়ে গেছে।'

মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন যে বন্ধু

মুগ্ধ যখন গুলিবিদ্ধ হন, তখন পাশে ছিলেন তার বন্ধু জাকিরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, 'বুলেট মুগ্ধর কপালে লেগে মাথার ডান দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। আমাদের চোখের সামনে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে।'

'মুগ্ধ সবাইকে পানি খাওয়াচ্ছিল। আমাদের কারো কাছে কোনো ধরনের অস্ত্র বা লাঠিসোটাও ছিল না। তারপরও ওরা আমার বন্ধুকে এভাবে গুলি করে মারলো? এই দৃশ্য আমি কীভাবে ভুলব?', যোগ করেন জাকিরুল।

Comments

The Daily Star  | English

Why landscape-based knowledge is critical for Bangladesh

How will we build the country without landscaping knowledge?

16h ago