আস্থাহীনতায় বেসরকারি বিনিয়োগে ধীরগতি

অস্থিরতা ঠেকাতে সারাদেশে কারফিউ দেওয়ায় গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে।
বেসরকারি বিনিয়োগ
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি অব্যাহত ডলার সংকট, আস্থাহীনতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গত তিন বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসাবে কমছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ও জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ।

দেশে প্রবৃদ্ধির ধীর গতির মধ্যে সম্প্রতি মাসব্যাপী ছাত্র আন্দোলন অর্থনীতির জন্য আরেক বড় ধাক্কা। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।

অস্থিরতা ঠেকাতে সারাদেশে কারফিউ দেওয়ায় গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে।

কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট বন্ধ করায় দেশ বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ে।

যদিও দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তবুও বিদ্যমান অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা নিশ্চিতভাবেই বেসরকারি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে।'

তবে ভালো নীতি ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা গেলে বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

'বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সব সময় নিজেদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চান' উল্লেখ করে মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, 'তাই বর্তমানের সমস্যা সাময়িক হলেও আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে তাদের আশঙ্কা কিছুটা কমতে পারে।'

ইন্টারনেট বন্ধের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'ছাত্র বিক্ষোভে লাগাম টানতে এমনটি করা হলেও এটি দেশ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের মনোভাব নেতিবাচক করেছে।'

'যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় দেশের ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে।'

মাসরুর রিয়াজ সুশাসন নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ ও ব্যবসা সহজ করতে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।

গত ২৮ জুলাই ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে দেখা করে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরেন।

সংগঠনটির মতে, সম্প্রতি সারাদেশে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় তা অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ক্ষতি হয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

ফিকির সভাপতি জাভেদ আখতার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক বিনিয়োগকারী বর্তমানে নিয়মিত কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন। বন্দর থেকে পণ্য খালাস ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনায় সমস্যা ও অদক্ষতার কারণে ব্যবসার খরচ বাড়ছে।'

'ব্যবসা সহজ করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হলে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কাছে এ দেশকে বিনিয়োগের সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হবো,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

'বিনিয়োগকারীরা দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন,' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সমস্যা সমাধান করতে হবে। এখনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়।'

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পিইবির বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স ২০২৪ অনুসারে, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে বেশকিছু বাধা অতিক্রম করতে হবে।

প্রতিষ্ঠান দুইটি বলছে, গত জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সরকারের বেঁধে দেওয়া ১১ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার কম হয়েছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আগের বছরের ১০ দশমিক নয় শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় ১০ দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত তিন বছরে বিনিয়োগের সম্ভাবনা কমেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে আমদানি কমানো, জ্বালানির দামের সমন্বয়, টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ও ক্রমবর্ধমান সুদের হার ব্যবসায়ের পরিবেশ নষ্ট করেছে।'

'ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ঘাটতি ও ঘন ঘন গ্যাস সংকটের কারণে এসব সমস্যা আরও বেড়েছে' বলে মনে করেন তিনি।

তার ভাষ্য, 'সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ পরিবেশের অবনতি হয়েছে। নীতিনির্ধারকরা তা বুঝতে পারেননি অথবা মেনে নিতে চাননি। তাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে এগুলোকে মেনে নেওয়া দরকার।'

তিনি আরও বলেন, 'বড় ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে পেলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সমস্যায় পড়েছেন। বিনিয়োগের বর্তমান চাপ মোকাবিলায় আমরা যদি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি নিতে চাই তাহলে এই অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই করতে হবে।'

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে জিডিপির ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশে বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছে। এটি আগের অর্থবছরের ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশের তুলনায় বেশি।

Comments

The Daily Star  | English

Mob justice is just murder

Sadly, when one lynching can be said to be more barbaric than another, it can only indicate the level of depravity of some our university students

1h ago