কার্টুনে বিদ্রোহ: শিল্পীর ছোঁয়া কথা বলে যেথায়
দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে একটা দেহ জড়িয়ে আছে দড়িতে। যেন টান দিলেই গড়িয়ে পড়বে মাটিতে। বাম দিকে ঝুলছে তার আলোচনার নামে প্রহসনের বুলির ছবি, আর সামনে এগোলেই তার ছুটে পালানোর তড়িঘড়ি। চারদিকে চোখ বোলালে দেখা যায় লাল রঙের ওপর শত শত কার্টুনের ছড়াছড়ি। রক্ত দিয়ে ইতিহাস গড়ার প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরছে দৃক গ্যালারির 'কার্টুনে বিদ্রোহ' প্রদর্শনী।
কে ভেবেছিল, যে দেশে পান থেকে চুন খসলেই যেতে হয় গারদের ওপারে, সে দেশে কারো বিদায় উদযাপন করা যাবে একদিন মহা আড়ম্বরে। স্বৈরাচারের সিংহাসনের পায়া একেক করে ভাঙার দিনগুলো এক ঝটকায় চোখের সামনে ভেসে উঠছে কার্টুনগুলোর দিকে তাকালে। হাসির খোরাকের উপকরণ যেমন আছে একদিকে, শত শত তাজা প্রাণ হারিয়ে যাওয়ার কষ্টে মন বিষণ্ণ হতে পারে অন্যদিকে। এক কথায় 'কার্টুনে বিদ্রোহ' পুরো সংগ্রামকে তুলে ধরেছে ছোট্ট গ্যালারির দেয়ালে দেয়ালে।
র্যাপ গানে প্রতিবাদ করার জন্য যাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল, সেই শিল্পীর গান বাজছে এক কোণে। মুগ্ধর 'পানি লাগবে, পানি?'র কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ঝুলন্ত পানির বোতলে রাখা হয়েছে মুগ্ধর নাম, ইনস্টলেশন আর্টে লেখা হয়েছে প্রতিবাদী স্লোগান। কার্টুনে বিদ্রোহ সত্যিকারের বিদ্রোহ করে বসেছে বলা যায়।
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়, মেহেদী হক, মাহাতাব রশিদের মতো নামকরা কার্টুনিস্টদের পাশাপাশি নবীনদের আঁকা কার্টুন। আন্দোলনের শুরু থেকে এক দফা দাবি পর্যন্ত যেসব ঘটনা দাগ কেটেছে সবার মনে সবগুলোই ফুটিয়ে তুলেছেন রঙতুলিতে। আঙুলের স্পর্শে আঁকা প্রতিবাদের এই ভাষা যে কতটা তীব্র তা উপলব্ধি করতে পারবেন এখানে এলে। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানানোর উপায়ও রাখা হয়েছে মন্তব্য খাতা, হোয়াইট বোর্ডের মাধ্যমে। যেখানে কলম, মার্কারে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে দেখা গেছে অনেককে।
কার্টুনের মাধ্যমে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিবাদ করার চলমান ধারা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয় সেখানে আসা নির্মাতা আশফাক নিপুনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, 'কার্টুন অনেক আগে থেকেই প্রতিবাদের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। নিজের ক্ষমতা যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেজন্য শেখ হাসিনা সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, কার্টুন আঁকা নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। তার রাজত্ব যে টিকবে না তা ধারণা করেছিলাম। প্রতিবাদের ঝড় তুলতে কার্টুনে বিদ্রোহের মতো আয়োজন আমাদেরকে উৎসাহিত করবে ভবিষ্যতে।'
কার্টুনিস্ট ইদরাক শারার রেজা বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ে আমরা যারা কলম তুলতে ভয় পেতাম, তাদের হাঁটুবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে অনেক শেখার আছে। তারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে মাঠে নেমেছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গুলির সামনে বুক পেতেছে। আমাদেরও উচিত নিজেদের বিবেকের মুখোমুখি হওয়া। সেই জায়গা থেকে অনেক কার্টুনিস্ট স্ব স্ব উদ্যোগে প্রতিবাদ করেছেন। আমরা সেগুলো একত্র করার চেষ্টা করেছি যাতে সেগুলো হারিয়ে না যায়। যদি স্বৈরাচার টিকে থাকত, তবুও আমরা কোনো না কোনাভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতাম।'
কার্টুনে বিদ্রোহ আয়োজনের স্মৃতি ধরে রাখতে প্রবেশদ্বারের পাশে দেওয়া হয়েছে স্টল। যেখানে পাওয়া যাচ্ছে পোস্টার, টোট ব্যাগ, টি-শার্ট, নোটবুক। দাম পড়বে পোস্টার প্রতি ১০ টাকা, নোটবুক ৩৫০ টাকা, টোট ব্যাগ ৩৫০ টাকা, টি-শার্ট ৪৫০ টাকা। ইচ্ছে হলে আপনিও সংগ্রহে রাখতে পারেন সেগুলো। আসার সময় ফ্রেমবন্দি করে নিয়ে আসতে পারেন অভাবনীয় অনুভূতি।
বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, দৃক ও ইয়ার্কির সহযোগিতায় রাজধানীর পান্থপথের দৃক গ্যালারির এই 'কার্টুনে বিদ্রোহ'তে রাখা হয়েছে ৮২ জন কার্টুনিস্টের আঁকা প্রায় ১৭৫টি কার্টুন। গত শুক্রবার উদ্বোধন করার পর প্রতিদিনই দর্শকের উপস্থিতি বাড়ছে। আয়োজন চলবে ২৩ আগস্ট বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
Comments