শিশুদের জন্য বাংলা ইউটিউব কার্টুন চ্যানেলের খোঁজ
শুধু বিনোদনের জন্য নয়, শিশুদের ভাষা বিকাশ এবং জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের জন্যও বিশ্বজুড়ে বহুল প্রচলিত একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে কার্টুন। দ্বিমাত্রিক এই চলচ্চিত্রকলার ধারা বাংলা ভাষাতেও খুব একটা নতুন নয়।
কিন্তু ইউটিউবে বাংলা কার্টুনের পদচারণা সর্বোচ্চ এক দশক আগে। সেই থেকে বাংলা ভাষার পাশাপাশি শিশুদের স্বাভাবিক ক্রমবিকাশের জন্য বিরাট অবদান রেখে চলেছে এই কন্টেন্টগুলো। আজকের নিবন্ধটি তেমনি কিছু শিশুতোষ ইউটিউব কার্টুন চ্যানেল নিয়ে। চলুন দেখে নেওয়া যাক শীর্ষস্থানীয় ইউটিউব কিডস বাংলা চ্যানেলগুলো।
বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য মজার কিছু ইউটিউব কার্টুন চ্যানেল-
ইনফোবেলস বাংলা
সব বয়সের শিশুদের সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে উন্নত করার লক্ষ্যে এক সৃজনশীল দল গঠন করেছেন কুবের নটরাজন এবং তার স্ত্রী জয়লক্ষ্মী কুবের। ইনফোবেলস বাংলা তাদেরই ব্রেইনচাইল্ড।
বাংলার মানুষের মুখে মুখে খ্যাতি পাওয়া ছড়া ও গানগুলোকে আকর্ষণীয়ভাবে প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের কর্ণাটকভিত্তিক চ্যানেলটি শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৩ জুন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত পুরো কুবের টিম ভিডিও প্রকাশ করেছে মোট ৪০৬টি।
৭ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের সুফল স্বরূপ তারা পেয়েছেন ১৭ কোটি ৪০ লাখ গ্রাহকের এক বিশাল পরিবার। সর্বমোট ৮ দশমকি ৮৫ বিলিয়ন ভিউ পাওয়া ভিডিওগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া মিলেছে লালাজি চরিত্রের গল্পগুলোতে।
বেঙ্গলি ফেয়ারি টেলস
অনলাইনে কার্টুন গল্পের চিত্তাকর্ষক বিষয়টিকে সবচেয়ে সফলভাবে উপজীব্য করতে পেরেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেলটি। ২০১৬ সালের ৬ জুন থেকে বাংলা ভাষাভাষি নেটিজেনদের কাছে স্বনামধন্য একটি নাম বেঙ্গলি ফেয়ারি টেল্স।
তারা নামকরা সব বিদেশি রূপকথাগুলোর বাংলা ভার্সন নিয়ে তৈরি করেছে ৬৬৬টি ভিডিওর বিশাল এক সংগ্রহশালা। এখানে আছে স্লিপিং বিউটি থেকে শুরু করে আগলি ডাকলিং বা কুৎসিত হাঁসের বাচ্চা, জেলে ও তার স্ত্রী, থাম্বেলিনা, ও সিনডারেলার মতো কল্পকাহিনী।
তাদের মোট গ্রাহক সংখ্যা ৮ কোটি ৬০ লাখ এবং শুরু থেকে এ পর্যন্ত সব ভিডিওতে পাওয়া ভিউ সংখ্যা ৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন।
কিডস টিভি বাংলা-নার্সারি রাইমস
ভারতের কিডস টিভি ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই থেকে তাদের বিনোদন প্রচার সেবা প্রসারিত করেছে বাংলা ভাষাভাষিদের জন্যও। বিশ্ব জোড়া প্রতিটি বাবা-মার মুখে নার্সারি রাইমস মানেই এখন কিডস টিভি বাংলা।
তবে শুধু ছড়া আর গান নয়; মজার মজার কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা নিয়ে ৭৭১টি ভিডিওর সমৃদ্ধ এক রিসোর্চ এই চ্যানেল। দীর্ঘ ৮ বছরের স্ট্রিমিং কার্যক্রমে তাদের অর্জন ১৭ লক্ষাধিক গ্রাহক এবং ৭২২ মিলিয়নের বেশি ভিউ।
ইনরেকো চিলড্রেন
চমকপ্রদ কন্টেন্টের মাধ্যমে বাংলার লোক সাহিত্যের গল্প, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন ও গানকে অনবদ্যভাবে তুলে এনেছে এই ভারতীয় ইউটিউব চ্যানেলটি। ১৩ লাখ ৬০ হাজার সাবস্ক্রাইবারের বিশাল পরিবারের শুরুটা ছিলো ২০১৪ সালের ২১ মে। তারপর থেকে সুদীর্ঘ ৯ বছরে মোট কন্টেন্ট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০৪টি। এগুলোর সবকটিতেই গানের কথা লিখেছেন সলিল চৌধুরী এবং কণ্ঠ দিয়েছেন অন্তরা চৌধুরী।
এ পর্যন্ত ভিডিওগুলো ভিউ পেয়েছে ৬৫৪ মিলিয়নেরও অধিক এবং এখনও মুগ্ধতা ছড়িয়ে চলেছে প্রতিটি শিশুর মাঝে।
কিডিজ টিভি বাংলা
বাংলাতে বাচ্চাদেরকে বর্ণমালা ও রং চেনানোসহ বিভিন্ন ধরনের মজার অ্যানিমেশনের অভিজ্ঞতার জন্য দেখতে হবে কিডিজের কন্টেন্টগুলো। ভারতীয় ইউটিউব চ্যানেলটি ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে প্রকাশ করে আসছে এমন বিস্ময়কর চিত্রনাট্য। ১৪৬টি ভিডিওর প্রতিটিতেই বাচ্চাদের জন্য রয়েছে আনন্দ ও চমকের মাধ্যমে যে কোনও কিছু শিখে নেওয়ার রসদ।
২ দশমিক ০৩ বিলিয়নের অধিক ভিউ পাওয়া ভিডিওগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে হাম্পটি রেইলগাড়ি চরিত্রটি। চ্যানেলের মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫০ লাখ ৭ হাজার।
চুচুটিভি বাংলা
২০১৯ সালের ১ আগস্ট ভারত থেকে চ্যানেলটি তার কার্যক্রম শুরু করার পর থেকেই এর হাস্যরস ও নির্মল আনন্দ নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে যায়। সব বয়সের এমনকি বাড়ন্ত বয়সের শিশুদেরও নজর কেড়ে ফেলে খুব কম সময়ের মধ্যেই। ৭০ লাখ ৯৬ হাজার গ্রাহক এবং ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ভিউ সে কথাই সমস্বরে জানান দিচ্ছে। ৪ বছরে তাদের মোট ভিডিও ৩১৮টি। যেগুলো এখনও সুনামের সঙ্গে চ্যানেলের নাম ধরে রেখেছে।
কুকুটিভি বাংলা
চুচুটিভির ঠিক দেড় বছর আগে ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি একই রকম গল্প বলতে সূচনা হয় কুকুটিভি বাংলার। তবে ভারতীয় ইউটিউব প্রচার মাধ্যমটির বিশেষত্ব ছিল এর অ্যানিমেশনে যেগুলো ছিল আরও বর্ণিল। যে কারণে স্ক্রিন থেকে চোখ সরানোই দায় হয়ে যায়। এইভাবে নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলো অবচেতনে মস্তিষ্কে গেঁথে দেয় জীবন-নির্ভর ও নৈতিক শিক্ষা।
বিগত ৫ বছরে তারা ১ হাজার ৫৩টি ভিডিও বানাতে সক্ষম হয়েছে। ধারাবাহিকতার ইতিবাচক ফলস্বরূপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিলেছে ৫০ লাখ ৩৫ হাজার গ্রাহক এবং ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ভিউ।
কিডস প্ল্যানেট বাংলা
কোনো কারণে বাচ্চার মুড খারাপ থাকলে তার জন্য এই ইউটিউব চ্যানেলটি ছেড়ে দেওয়া যথেষ্ট হবে। আর এই কারণেই ১০ লাখ ২৫ হাজার গ্রাহকের এই ভারতীয় চ্যানেলটি প্রতিটি মা-বাবার প্রথম পছন্দ। ঘুম থেকে উঠে স্বাগত গান, খেলার সময় মজার ছড়া এবং ঘুমানোর সময় লুলাবাই; সবই আছে এখানে।
আকর্ষণীয় চরিত্রগুলোর সঙ্গে সঙ্গে অনুকরণপ্রিয় শিশু অবলীলায় ঠোঁট নাড়াতে উদ্যত হয়। ফলে অবচেতনেই হয়ে যায় উচ্চারণ ও কথা বলার পাঠ। ঠিক এমনি মজার উপকরণে সজ্জিত করে সেই ২০১৭ সালের ২০ জুন থেকে একে একে ৪১০টি ভিডিও বানিয়েছে কিডস প্ল্যানেট বাংলা। ৪৬৬ মিলিয়নের অধিক ভিউ পাওয়া ভিডিওগুলো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শিশু দর্শকের প্রিয় সঙ্গীতে পরিণত হচ্ছে।
মুপল টিভি বাংলা
২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর শুভ মহরত হওয়া ভারতের মুপল টিভি বাংলা হচ্ছে শিশুদের টিভি। একটি শিশুর সারাদিনে রীতিমতো নিয়ম করে প্রতি মুহূর্তের প্রাসঙ্গিক গল্প দেখাবে এর প্রোগ্রামগুলো। আর তাই এই ৫ বছরে মাত্র ১১৪টি ভিডিও বানিয়েও এদের ১০ লাখ ৩৪ হাজার গ্রাহক।
কখনও মা, কখনও দাদী, কখনও বা ভাই-বোনের মতো করে ছড়ার শব্দগুলোকে আধো আধো বুলিতে পরিণত হতে সাহায্য করছে কন্টেন্টগুলো। ইউটিউব চ্যানেলটির বর্তমান ভিউ সংখ্যা ৫৬৭ মিলিয়নের বেশি।
গীতাঞ্জলি কিডস বেঙ্গলি
৩২৩টি ভিডিও সমৃদ্ধ গীতাঞ্জলি কিডস বেঙ্গলি শুধু ছড়া নয়, গল্প ও খেলাচ্ছলে শেখার সংগ্রহশালা। রপুঞ্জেল, সিন্ডারেলা, স্লিপিং বিউটি, বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট, রাম্পল্সটিল্ট্স্কিন ও থাম্বেলিনার মতো রূপকথাগুলো আছে প্রশান্তি ও আনন্দের জন্য। অন্যদিকে পিনকিও, হ্যান্সেল অ্যান্ড গ্রেটেল, জ্যাক অ্যান্ড দ্য বিন্স্টক, দ্য জিঞ্জারব্রেড ম্যান, গোল্ডিলক্স ও তিন ভাল্লুক এবং লিটল রেড রাইডিং হুড চেনাবে রোমাঞ্চের স্বাদ!
এই সবকিছুর শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় ইউটিউব চ্যানেলটির বর্তমান সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১১ লাখ ৩ হাজার এবং ভিউ সংখ্যা ৩৪৫ মিলিয়ন।
খেয়ালখুশি বেঙ্গলি রাইমস
নামের মতোই কার্যক্রমগুলোও হেয়ালিপনার এই ভারতীয় ইউটিউব স্ট্রীমিং চ্যানেলটির। ছোট ছোট অ্যানিমেটেড ভিডিওগুলোতে কেন্দ্রীয় বিষয় রং, সংখ্যা, প্রাণীর আকৃতি, ভালো অভ্যাস এবং মূল্যবোধ শেখানো।
২০১৭ সালের ১৫ মের পর থেকে ১৪৭টি ভিডিওর মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতি পেয়েছে সোনামণিদের জন্য রচিত চিরাচরিত ছড়াগুলো। বর্তমানে মোট খেয়ালখুশি বেঙ্গলি রাইমসের ভিউ সংখ্যা ১ দশমিক ৩ বিলিয়নের অধিক এবং গ্রাহক সংখ্যা ২ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন।
বিডি কিডস টিভি
২০১৭ সালের ১১ মে বিডি কিডস টিভি প্রতিষ্ঠা করেন খাইরুল বাশার নয়ন এবং মহিমিল মোস্তফা। এটি ছিল মূলত ফিল্ম ক্যাসেল ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের একটি উদ্যোগ। বাংলাদেশে এটিই প্রথম ও বৃহত্তম শিশুতোষ বাংলা ইউটিউব কার্টুন চ্যানেল। ভারতীয় বাংলাগুলোর মতো এখানেও আছে নার্সারি রাইমস এবং ছড়াগান। তবে সেগুলোকে বিশেষায়িত করা হয়েছে বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতি দিয়ে।
এখানে ঠায় পেয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, কাক ও কলসি, আতা গাছে তোতা পাখি, ছুটি, ইতল-বিতল, আমাদের ছোট নদী, ও কাজলা দিদি।
এ ছাড়াও রয়েছে বাংলা বর্ণমালা ও ছবি আঁকার নানা কলা কৌশল। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ গ্রাহক সমৃদ্ধ এই চ্যানেলের কন্টেন্টগুলোর প্রধান চরিত্র সামিন ও ফারিন। এখন পর্যন্ত মাত্র ৪২টি ভিডিও বানানো হলেও তাতে ভিউ জমা পড়েছে ১৩০ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন।
শিশুদের বিনোদনের জন্য নিবেদিত এই ইউটিউব কার্টুন চ্যানেলগুলোর মধ্যে বেশ কম সময়ে অনেক বেশি গ্রাহক ও ভিউ অর্জন করেছে চুচুটিভি বাংলা। অন্যদিকে, কুকুটিভি বাংলাকে তার বর্তমান অর্জনের জন্য তুলনামূলক বেশি সংখ্যক ভিডিও বানাতে হয়েছে।
অবশ্য সাবস্ক্রাইবার ও ভিউয়ের দিক থেকে এটি অনেকটা এগিয়ে আছে একই সময়ে শুরু হওয়া চ্যানেল মুপল টিভি বাংলা ও গীতাঞ্জলি কিডস বেঙ্গলি থেকে। একইভাবে কিডস প্ল্যানেট বাংলা, খেয়ালখুশি বেঙ্গলি রাইমস ও বিডি কিডস টিভিকে প্রতিযোগিতায় ছাড়িয়ে গেছে একই সময় যাত্রা শুরু করা কিডিজ টিভি বাংলা।
অপেক্ষাকৃত স্বল্প ভিডিও দিয়ে মিলিয়নের ঘরে রয়েছে সবচেয়ে পুরোনো চ্যানেল ইনরেকো চিলড্রেন। সামগ্রিকভাবে শীর্ষস্থানে থেকে কারিগরি দিক থেকে গুণগত এবং অভিনব কন্টেন্টের মাধ্যমে নিজের গ্রাহকদের বিনোদিত করছে ইনফোবেলস বাংলা।
সর্বোপরি, ইন্ডাস্ট্রিতে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও শিশুদের সঙ্গে বাংলা লোক-সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য সংযোগ গড়ে তুলছে বাংলা ইউটিউব কার্টুন চ্যানেলগুলো।
Comments