‘তোমরা তো ভিতরে যাও, আমার বাবার খবরডা লইও’

গাজী টায়ার কারখানা
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী গ্রুপের টায়ার কারখানায় আগুনে নিখোঁজদের স্বজনদের আহাজারি। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

গত ২৫ আগস্ট লুটপাটের পর রাত নয়টায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসীতে গাজী গ্রুপের টায়ার কারখানার ছয়তলা ভবনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা৷ দীর্ঘ সময় পরও কারখানায় উদ্ধার অভিযান শুরু না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভেতরে আটকে পড়া ব্যক্তিদের স্বজনরা৷ উদ্ধার অভিযান শুরু করতে দেরি কেন তা জানতে চান তারা৷

ঘটনার দিন কারখানায় এসে নিখোঁজ হন মো. আমান উল্লাহ (২১)৷ ছেলের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে তিনদিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাবা আব্দুল বাতেন ও মা রাশিদা বেগম৷ তিনদিনই আমানের পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়েছে এ প্রতিবেদকের৷

চার ভাই-বোনের মধ্যে সেজো আমান স্থানীয় ব্যাটারি কারখানায় কাজ করতেন৷ পরিবারের সঙ্গে তারাব বিশ্বরোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি৷

আমানের খোঁজ পেতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ করেছেন পরিবারের সদস্যরা৷ কোথাও খোঁজ মেলেনি৷

গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে কারখানার প্রধান ফটকের সামনে রাশিদা বেগমের সঙ্গে দেখা হলে 'কারখানার ভেতরে কারও লাশ পাওয়া গেছে কিনা' জানতে চান৷ ইতিবাচক উত্তর না পেয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন এই নারী। তিনি বলেন, 'চাইরদিন ধইরা তারা করতেছে কী? কত মানুষ দেহি বড় বড় খালি গাড়ি লইয়া আহে আর যায়, তারা কি কিচ্ছু করে না? আমার পোলাডারে তো পামুই না জানি, কঙ্কালটা পাইলেও তো আত্মাতা ঠান্ডা হইতো৷ হেইডাও তো দিতেছে না৷'

প্রতিদিন কারখানার সামনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের পাশাপাশি স্থানীয় উৎসুক জনতাও এসে ভিড় করছেন৷ গতকাল সকাল থেকে উৎসুক জনতার পাশাপাশি স্বজনদের কারখানার সামনে ভিড় না করার অনুরোধ জানান নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা৷

এ অনুরোধে অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করেন৷ ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় কাউকে৷

গাজী টায়ার কারখানা
নিখোঁজদের খোঁজে পুড়ে যাওয়া কারখানার সামনে স্বজনদের ভিড়। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

রাশিদা বেগম ডেইলি স্টারকে আরও বলেন, 'আমার পোলা পাইতেছি না, আর আমারে কইতেছে, ভিতরে কেউ নাই। যান গা৷ নিখোঁজ মানুষরে দিতারে না, খালি মানু খেদাইয়া দেয়৷ বাইর কইরা দেয়৷ তারা তো কিছু কয় না৷ বাবা, তোমরা তো ভিতরে যাও, আমার বাবার খবরডা লইও৷'

সন্ধ্যায় নিখোঁজ মনির হোসেনের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে ভাই জাকিরকে কারখানার ভেতরে দেখা যায়৷ মনির গাজী টায়ারস কারখানার শ্রমিক ছিলেন বলে দাবি জাকিরের৷ গত ৫ আগস্টে প্রথম দফা এই কারখানায় হামলার পর এর উৎপাদন কাজ বন্ধ থাকায় আর কাজে আসেননি৷ জুলাইয়ের বেতনও তার বকেয়া বলে জানান জাকির৷

গত ২৫ আগস্ট রাতে কারখানাটিতে আগুন দেওয়ার আধ ঘণ্টা আগে বন্ধুদের সঙ্গে আসেন মনির৷ ভবনটির তৃতীয় তলায় ছিলেন তিনি৷ আগুন লাগার পর সঙ্গে থাকা তিন বন্ধু বেরিয়ে যেতে পারলেও মনির আটকা পড়েন৷

মনিরের ভাই জাকির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একদিন পর উদ্ধারে গেলেও লাশটা পাইতাম৷ এখন তো কিচ্ছু পামু না৷'

ফায়ার সার্ভিস ও নিরাপত্তায় থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গতকাল দুপুরে ভবনটির ভেতরে ঢুকেছিলেন বলে দাবি করেন ইউসুফ আলী৷ তার ১৯ বছর বয়সী ভাতিজা মো. মজনু ইসলাম নিখোঁজ৷

'প্রতিদিন আসতেছি, প্রতিদিনই ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি৷ উদ্ধার তো কাউরে করতেছে না৷ সাহস কইরা আজকা সিঁড়ি দিয়া তিনতলা পর্যন্ত গেছিলাম৷ অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না৷ আমি যদি যাইতে পারি, প্রশাসনের লোকজন কেন যাইতে পারে না?'

বিকেলে কারখানা পরিদর্শন শেষে প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ভবনটি অনিরাপদ থাকায় উদ্ধার অভিযান শুরু করা যাচ্ছে না৷ উদ্ধার অভিযান শুরু করা যাবে কিনা তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে৷

হামিদুর রহমানের কথাগুলো শুনছিলেন ইউসুফ৷ প্রশাসনের লোকজন একটু সরে গেলে এ প্রতিবেদকের কাছে ইউসুফ জানতে চান, 'কালকে কী তারা (ভবনে) ঢুকবে ভাই? নাকি কালকেও বলবে পরশুর কথা? এত দেরি কেন করতেছে?'

রূপগঞ্জের গাজী টায়ারসে আগুনের ঘটনার চারদিন পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত ছয়তলা ভবনটিতে উদ্ধার অভিযান শুরু করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস৷ ভবনটি 'অনিরাপদ' থাকায় উদ্ধার অভিযান শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা৷

গতকাল বিকেলে প্রশাসনের তদন্ত কমিটি কারখানাটি পরিদর্শন করে জানিয়েছে, উদ্ধার অভিযানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে বৃহস্পতিবার৷ স্থানীয় জনবলের মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব না হলে জাতীয়ভাবে অভিজ্ঞদের সহযোগিতা চাওয়া হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দলকে ডাকা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান৷

প্রয়োজনে স্বাস্থ্য বিভাগের অভিজ্ঞদের সহযোগিতাও নেবেন তারা৷

গাজী টায়ার কারখানা
আগুনে নিখোঁজ ব্যক্তির ছবি হাতে স্বজন। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

গতকাল বিকেলে কারখানাটি পরিদর্শনে আসেন কমিটির সদস্যরা৷ ফায়ার সার্ভিস, জেলা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, কলকারখানা অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ, তিতাস, পল্লী বিদ্যুতের প্রতিনিধিরা তাদের সঙ্গে ছিলেন৷

তারা কারখানা কর্তৃপক্ষ, প্রত্যক্ষদর্শী, নিখোঁজদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন৷

কমিটির প্রধান হামিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'গত ২৫ আগস্ট কিছু অনুপ্রবেশকারী কারখানায় ঢুকে লুটপাট চালায়। রাতে ভবনটিতে আগুন দেওয়া হয়। তখন অনেকে আটকা পড়েন।'

নিখোঁজদের ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তালিকা করা হয়েছে জানালেও কতজন তালিকাভুক্ত হয়েছেন সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি৷

হামিদুর রহমান আরও বলেন, 'যে ব্যক্তি এসে বলছেন যে তার স্বজন নিখোঁজ আছেন তাদের নাম-ঠিকানা লিখে নিয়েছি। প্রকৃত সংখ্যা বলতে পারছি না৷ তবে আগুনের সময় ভবনটিতে শতাধিক ব্যক্তি ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন৷ এখানে একজন মানুষ থেকে থাকলেও তা গুরুত্বের সঙ্গে নেবো৷ আমাদের মূল চেষ্টাটা হলো ভেতরের অবস্থাটা কী তা দেখা৷'

ফায়ার সার্ভিস ড্রোন ও বড় মই (টিটিএল) দিয়ে ভবনের ভেতরে একাধিকবার অনুসন্ধান চালিয়েছে৷ ভবনটির চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত মেঝে ধসে পড়েছে৷ এখন পর্যন্ত মরদেহের সন্ধান মেলেনি বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান৷

তিনি বলেন, 'এখানে যেহেতু অনেক বেশি কেমিক্যাল পুড়েছে, তাই কোনো মানুষকে অক্ষত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ অন্তত ২২ ঘণ্টা টানা আগুন জ্বলেছে।'

মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ছাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানিয়েছিলেন, ভবনটিতে আগুন থাকায় তারা ভেতরে ঢুকতে পারেননি৷ বুধবার ভবনটি পরিদর্শন করে ভেতরে ঢুকে অনুসন্ধান কাজ চালানো যাবে কিনা সে ব্যাপারে পরামর্শ দেবেন৷

বুধবার সন্ধ্যায় তিনি ডেইলি স্টারকে জানান, আগুন নেভানো গেলেও ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে৷ এ ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত দিতে পারছি না৷ বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল বৃহস্পতিবার আসবে৷ তারা সিদ্ধান্ত দেবেন৷

এদিকে, গতকাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে ভবনটিতে আবারও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে৷

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল মন্নান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখনো আগুন আছে৷ সব তো প্ল্যাস্টিক আর রাবার। এগুলো গলে গলে পড়লে আবার আগুন ধরে যায়৷ এ আগুন ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই৷ আমরা কাজ করছি৷'

গত রাতে ইউএনও আহসান মাহমুদ রাসেল ডেইলি স্টারকে জানান, বৃহস্পতিবার সকালে ভবন পরিদর্শনে আসবে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী নিখোঁজদের খোঁজে ভবনে অনুসন্ধান চালানো হবে।

Comments

The Daily Star  | English
5G network services in Bangladesh

Bangladesh enters 5G era with limited rollout

Bangladesh has finally entered the 5G era, as the country’s top two mobile operators yesterday announced the limited launch of the technology, aiming to provide ultra-fast internet, low latency, improved connectivity, and support for smart services and digital innovation..Unlike previous g

1h ago