জীবনদায়ী শোলমারীর প্রাণ বাঁচানোই দায়

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

নিসর্গের কবি জীবনানন্দ দাশ নদীকে ভালোবেসেছিলেন প্রিয় মানুষের মতোই। লিখেছিলেন, 'যে-নদী হারায়ে যায় অন্ধকারে-রাতে-নিরুদ্দেশে,/তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়!'

কিন্তু হৃদয় কাঁপিয়ে তোলার মতো সেই দাপুটে স্রোত আর নেই খুলনার বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা শোলমারী নদীর। ভাটার সময় নদীটি যেন সরু নালা, তাতে তখন নৌকা চালানোই দায়। হেঁটেই পার হয় মানুষ। জোয়ারে পানি সর্বোচ্চ সাত ফুট উচ্চতায় ওঠে।

শোলমারীর এই করুণ দশা একদিনে তৈরি হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি নদী হত্যায় মানবসৃষ্ট নানা আয়োজন শোলমারীর এই মরণদশাকে ত্বরান্বিত করেছে।

হাইকোর্টের দেওয়া যুগান্তকারী রায়ে দেশের সব নদীকে 'জীবন্ত সত্তা' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। নদীকে এই জীবন্ত মানবিক সত্তার মর্যাদা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, নদী যে জীবন্ত মানুষের মতো মানবিক অধিকারের ধারক, তা মেনে নেওয়া। একটা মানুষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যেমন তার মতামত, ভালো-মন্দের দাম দিতে হয়, নদীর ক্ষেত্রেও তা-ই করতে হবে। নদীর কথা বলার আগে নদীর কথা শুনতে হবে।

কিন্তু দেশের আরও অনেক নদ-নদীর মতো শোলমারীর বেলাতেও এসবের কিছু মানা হয়নি। নদীর ভেতরেই জলকপাট তৈরি করে একে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। চর পড়ে যাওয়া জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে মাছের ঘের, ইটভাটাসহ অনেক অবৈধ ও অপরিকল্পিত স্থাপনা।

শোলমারী নদী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

অথচ এই খুলনা অঞ্চলের শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত ডুমুরিয়াসহ বটিয়াঘাটা অঞ্চলের কৃষির জন্য শোলমারী নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদী অববাহিকার অন্তত ১০০ গ্রামের পানির প্রধান প্রাকৃতিক উৎস এটি। দীর্ঘকাল ধরে সেচ ও পানিনিষ্কাশন—দুই ক্ষেত্রেই এই নদী ভূমিকা রেখে আসছিল। এখন শোলমারী নদীর যে অবস্থা, তাতে শিগগিরই এ অঞ্চলের কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়রা।

এক্ষেত্রে নদীবিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, প্রায় ভরাট হয়ে যাওয়া শোলমারীর বুকে স্রোতের স্পন্দন জাগাতে না পারলে বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও খুলনা শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে। শোলমারীর দুই পাড়ের গ্রামগুলোতে যে সমস্যা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুসারে, শোলমারীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৯ কিলোমিটার। উৎসমুখ বিল ডাকাতিয়ায়। এরপর এটি গুটুদিয়ার মধ্য দিয়ে কৈয়া হয়ে এসে শোলমারী খেয়াঘাট এলাকায় বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে বটিয়াঘাটা দিয়ে কাজীবাছা নদীতে পড়েছে। এই কাজীবাছা মিলেছে সুন্দরবনের পশুর নদে।

এদিকে শোলমারী খেয়াঘাটের ডান দিকে শোলমারী নদীর আরেক প্রবাহ সালতা-ভদ্রার সঙ্গে মিলে দক্ষিণে সুন্দরবনের আরেক নদী শিবসার দিকে প্রবাহিত হয়েছে।

আবার ফেরা যাক জীবনানন্দে। তিনি তার 'নদীরা' শিরোনামের কবিতায় লিখেছিলেন, '…একদিন এই নদী শব্দ ক'রে হৃদয়ে বিস্ময়/আনিতে পারে না আর;- মানুষের মন থেকে নদীরা হারায়- শেষ হয়।'

তাহলে একসময়ের প্রাণদায়ী শোলমারীর প্রাণও কি শেষ হয়ে যাবে?

Comments

The Daily Star  | English

Retaliation 'underway' as India hits Pakistan

New Delhi claims hitting 9 'terrorist sites'; Islamabad says civilians hit, claims downing 5 Indian jets; at least 8 killed; US, UN sound alarm

3h ago