কাঙালপনা

করোনা মহামারি-পরবর্তী সময়ে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। শঙ্কা ভুলে নতুন উদ্যম-উদ্দীপনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। সেদিনই অনুষ্ঠানের ব্যানারে লক্ষ্য করলাম একটা স্লোগান, 'শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'। স্লোগানটি দেখে একটু বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে পাশের সিটের সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই এটা কোন স্লোগান! এটা কি বাধ্যতামূলক? তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি মিয়া কোন দেশে থাকেন! এই স্লোগান কয়েক বছর ধরেই বাধ্যতামূলক। পরে পত্রিকার পাতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত যেকোনো বিজ্ঞাপন ও শিক্ষাঙ্গনের যেকোনো অনুষ্ঠানে দেখতাম উপরে জ্বলজ্বল করছে 'শেখ হাসিনার বাংলাদেশ...'।

২০২২ সালে পরিবারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। ফিরলাম মাস তিনেক পর। উড়োজাহাজ থেকে নেমে সরু ওয়াকওয়ে দিয়ে হেঁটে বিমানবন্দরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো 'ওয়েলকাম টু দ্য ল্যান্ড অব মুজিব' লেখা। মনের মধ্যে খচখচ করে উঠলো। দেশ আবার কারও হয় নাকি? আর এটাতো রীতিমতো ফ্যাসিবাদী দাবি। একটা উদাহরণ দিই। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিজবেন বিমানবন্দরে নানা ধরনের দাপ্তরিক কাজ শেষ করে আপনি যখন দেশটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করবেন, তখন দুটো বিষয় আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এক. কফিক্লাব নামের একটি দোকানের পোড়া কফির গন্ধ। দুই. একটি স্লোগান। যেখানে লেখা আছে 'গালাং নুরুংদায়' (Galang nguruindhau) যার অর্থ ব্রিজবেনে স্বাগত। এটি ব্রিজবেনের আদিবাসী জনগোষ্ঠী মিয়েনজিনদের (Meanjin) ভাষা। যারা শতশত বছর ধরে ব্রিজবেন নদীতীরের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছেন। যার সূত্র ধরেই আজকের ব্রিজবেন।

সেখানে লেখা নেই ওমুকের দেশে স্বাগত, তমুকের দেশে স্বাগত ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার ধারণা ন্যূনতম সভ্য দেশে এমন ব্যক্তিতোষণ ও দাবি চর্চা নেই। উত্তর কোরিয়াতে আছে কি না আমার জানা নেই। আমার নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন আমলের শেষ দিকে যেকোনো সামান্য বিবেকসম্পন্ন ভিনদেশি বাংলাদেশে প্রবেশ করেই বুঝতেন বাংলাদেশ এখন ফ্যাসিবাদের কবলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি আমি খণ্ডকালীন কাজের অংশ হিসেবে একটি টিভিতে সংবাদ পড়ি। সাধারণত রাতেই আমার সংবাদ পড়া হয়। গত ৯ মে একটি সংবাদের ইন্ট্রো ছিল অনেকটা এ রকম—'প্রকল্প-স্থাপনায় শেখ হাসিনার নাম না রাখার নির্দেশ'। খুব দারুণ ইতিবাচক, রুচিসম্মত সংবাদ। কিন্তু সংবাদের শেষ অংশে ছিল একটি আশ্চর্যজনক লাইন। সেদিন একনেক সভায় খুলনায় শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। কী অদ্ভুত দ্বিচারিতা! কী নিদারুণ প্রবঞ্চনা! নিজেই নির্দেশ দিচ্ছেন তার নাম না রাখতে, আবার তিনিই নিজের নামে প্রকল্পের অনুমোদন দিচ্ছেন।

উপরের ঘটনাগুলো আমার সামান্য পর্যবেক্ষণ। কিন্তু প্রায় ১৬ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামল পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাব, দেশের এমনকিছু নেই যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত হয়নি। আরও কয়েকটি উদাহরণ দিই। সারাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় ডিজিটাল ল্যাব স্থাপিত হবে, নাম 'শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব'। তথ্য ও যোগাযোগ অধিদপ্তর পুরস্কার দেবে, নাম 'শেখ রাসেল পদক'। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় পুরস্কার দেবে, নাম 'শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার'। মহিলা ও শিশু বিষয় মন্ত্রণালয় পদক প্রদান করবে, নাম 'বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক'। আর স্থাপনার কথা না হয় বাদই দিলাম।

১৬ বছরের শাসনামলে পার্ক, পাঠাগার, মাঠ-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক হল, সেনানিবাস—সবকিছুর নামই করা হয়েছে শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছিলেন বরিশালের লেবুখালিতে স্থাপিত শেখ হাসিনা সেনানিবাসের। কতটা নির্লজ্জ ও রুচিহীন হলে একজন প্রধানমন্ত্রী নিজের নামে একটি সেনা স্থাপনার নামকরণ করে, তা নিজেই উদ্বোধন করতে পারেন।

এসব নামকরণ ও প্রকল্পের পেছনে ফন্দি ছিল। জনগণের টাকায় নির্মিত এসব প্রকল্পে বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে শেখ পরিবারের নাম যুক্ত থাকায় কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। যে কারণেই আমরা দেখছি ১১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মাপাড়ে পিতা-কন্যার ম্যুরাল স্থাপিত হয়েছে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর! ঢাকঢোল পিটিয়ে উন্নয়নের আইকন হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নির্মাণ ও মহাকাশে পাঠিয়ে রাষ্ট্রের অপচয় শত শত কোটি টাকা। এ ছাড়া শেখ পরিবারে অক্ষয় কীর্তি ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশের মানুষের আর কত অর্থ যে গচ্চা গেছে, তার কোনো হিসাব নেই।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। ইতিহাসে তার অবস্থান মুছে ফেলা অসম্ভব। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দেবত্ব আরোপ করে তাকে বিভিন্ন স্থাপনা, ম্যুরাল, ভাস্কর্য ও আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টাটি ছিল একটি মারাত্মক ভুল ও অরুচিকর প্রচেষ্টা। যদিও ১৬ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা ঘুণাক্ষরেও বিষয়টি উপলব্ধি করার চেষ্টা করেননি। আর চেষ্টা করবেনই বা কীভাবে। তিনি তো প্রকাশ্যেই বলতেন 'এই দেশ, আমার দেশ। আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করেছে।' হায় কী নির্লজ্জ কাঙালপনা!

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-Myanmar border landmine explosion

Bangladesh-Myanmar border: Landmine-related injuries on the rise

Having lost her right leg in a landmine explosion, Nur Kaida, a 23-year-old Rohingya woman, now feels helpless at a refugee camp in Teknaf.

12h ago