আদালত প্রাঙ্গণে আসামি-আইনজীবীদের ওপর হামলা চলছেই
গত ২২ অক্টোবর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সামনে সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের পক্ষে শুনানি শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন। হঠাৎ বিএনপিপন্থী এক আইনজীবী এসে মোরশেদের মাথায় আঘাত করেন।
এর কিছুক্ষণ পর তিনি যখন আবার কথা বলছিলেন, তখন আরেক আইনজীবী মোরশেদের সামনে গিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে জোর করে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার আইনজীবী, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের ওপর আদালত প্রাঙ্গণে ধারাবাহিক হামলার সর্বশেষ ঘটনা এটি।
মোরশেদের ওপর হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
গত ১৪ আগস্ট একটি হত্যা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। ৫ আগস্টের পর সেদিনই প্রথম আদালত প্রাঙ্গণে এই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে। ওই দুইজনকে লক্ষ্য করে ডিমও নিক্ষেপ করা হয়।
আইনজীবী ও আদালতে কর্মরতদের মতে, বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা প্রায়ই আসামিদের পক্ষে লড়তে আইনজীবীদের বাধা দিতেন এবং কখনো কখনো শুনানির আগে ও পরে তাদের লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপও করতেন।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দায়ের করা মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর জোটের নেতাদের সিএমএম আদালতে হাজির করা হলে বিএনপিপন্থী আইনজীবীসহ একদল লোক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালত কক্ষে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন, যাতে কোনো আইনজীবী আসামির পক্ষে কাজ করতে না পারেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মীরা এই ধরনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এগুলো যাতে আর না ঘটে, সেজন্য আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
আইনজীবীদের মতে, শেখ হাসিনার শাসনামলের পতনের পর আওয়ামী লীগ সমর্থক অনেক সুপরিচিত আইনজীবী আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ হামলার ভয়ে নিজদলের গ্রেপ্তার নেতাদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াবার সাহস পাননি।
অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে সিএমএম আদালতে দাঁড়িয়ে হামলার শিকার হন আইনজীবী শেখ ফরিদও। আদালতে আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে দাঁড়ানো ছয় থেকে সাতজন আইনজীবীর মধ্যে আছেন ফরিদ ও মোরশেদ।
গত ১৭ অক্টোবর ফরিদ সিএমএম আদালত ভবন থেকে বের হওয়ার সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তাকে মারধর করে, লাথি ও ঘুষি মারে।
'আদালতে আমাদের মক্কেলদের পক্ষে দাঁড়ানোর অধিকার আমাদের আছে। কিন্তু আদালতের কার্যক্রমে অংশ নিতে গিয়ে আমাদের হয়রানি ও লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে', দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন ফরিদ।
গত ৭ অক্টোবর ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর ওপর হামলা হয়। সিএমএম আদালতের লকআপে নেওয়ার সময় সাবেরকে অন্তত তিনজন ঘুষি মারে। তাকে লক্ষ্য করে ডিমও ছোড়া হয়। বেশ কয়েকজন পুলিশকে হামলাকারীদের ঠেলে সরিয়ে দিতে দেখা গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে গত ২৪ আগস্ট সিলেটের আদালতে হাজির করা হয়।
তিনি পুলিশের গাড়ি থেকে নামার সময় একদল লোক তার মাথায় আঘাত করে এবং কেউ কেউ তার দিকে জুতাও ছুঁড়ে মারে। তাকে মারধর করা হয় এবং তার সুরক্ষায় পুলিশের দেওয়া হেলমেটও খুলে ফেলা হয়।
অণ্ডকোষে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করতে হয় সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এই বিচারপতিকে।
আইন অনুযায়ী হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেওয়া পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু তারা এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
পুলিশ রেগুলেশনের ৩২৮ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, থানা বা ফাঁড়িতে আনা সব বন্দির নিরাপদ হেফাজতের জন্য থানা বা ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দায়ী থাকবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আদালত চত্বরে আইনজীবী বা আসামিদের ওপর হামলার ঘটনা অতীতে ঘটলেও সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এ ধরনের ঘটনা রোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
'একজন আইনজীবী তার মক্কেলের পক্ষে দাঁড়াতে কোনোমতেই তাকে শারীরিক বা মৌখিকভাবে লাঞ্ছিত করা উচিত নয়। এটা পেশাগত আচরণের চরম লঙ্ঘন', গত ২৯ অক্টোবর ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী আরও বলেন, 'দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেককে নির্দোষ বলে ধরে নেওয়ার আইনি নীতি অবশ্যই বহাল রাখতে হবে; তা না হলে এ ধরনের অস্বস্তিকর ঘটনা চলতেই থাকবে।'
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, 'হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব এবং এ ধরনের সুরক্ষায় অভিযুক্তদের ওপর হামলা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।'
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, হামলাকারীদের কেউ কেউ নিজেরাই আইনজীবী। কোনো সভ্য সমাজে এ ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।'
এ ধরনের হামলাকে 'মব-জাস্টিসের নতুন ধরন' হিসেবে আখ্যা দিয়ে নূর খান বলেন, হামলাকারীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন বিভাগ) তারেক জুবায়ের বলেন, 'কোর্ট পুলিশ সদস্যরা নিরস্ত্র হওয়ায় তারা আদালত প্রাঙ্গণে মানবঢাল তৈরি করে অভিযুক্তদের রক্ষার চেষ্টা করেন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে তারা ডিএমপির লালবাগ বিভাগের সহায়তা নেন।
'অভিযুক্তদের নিরাপত্তার জন্য আমরা বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করছি। তাদের হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও পরিয়ে দেওয়া হয়', বলেন তিনি।
সম্প্রতি কয়েকজন আইনজীবীর ওপর সহকর্মীদের হামলার বিষয়ে তারেক বলেন, এসব ঘটনায় তারা বার কাউন্সিলে অভিযোগ করতে পারেন।
বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের প্ল্যাটফর্মের শীর্ষ নেতা ও ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, তাদের সহকর্মী আইনজীবীরা আসামিদের ওপর হামলা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত নন।
Comments