নেচার ম্যাগাজিনের শীর্ষ ১০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ছবি: নেচার’র প্রতিবেদন থেকে

প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী নেচারের ২০২৪ সালের সেরা ১০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গতকাল প্রকাশিত এ তালিকায় অধ্যাপক ইউনূসকে 'জাতির নির্মাতা' আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিপ্লবী অর্থনীতিবিদ থেকে বাংলাদেশের নেতৃত্বে ড. ইউনূস। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা কাঁধে নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান তিনি।

বাংলাদেশে কয়েক সপ্তাহের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে গত আগস্টে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসকে জাতির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হোক।

এ কাজটি অধ্যাপক ইউনূসের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ছয় দশকের কর্মজীবনে তিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করার উপায় বের করেছেন। সমস্যা সমাধানে তিনি গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণার ফলাফলের ওপর সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত ও পদ্ধতি নির্ধারণ করেন বলে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

অ্যালেক্স কাউন্টস ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করেছেন। তার মতে, 'তার (ড. ইউনূস) বয়স আশির কোঠায়। কিন্তু শারীরিক শক্তি ও মানসিক সামর্থ্য যথেষ্ট। তিনি সহানুভূতিশীল এবং যোগাযোগে খুবই পারদর্শী।'

ড. ইউনূসের জন্ম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের চট্টগ্রামে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে তার জন্মস্থান পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। ১৯৬০ এর দশকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে পরিবেশ বাস্তুগত অর্থনীতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নিকোলাস জর্জস্কু-রোগেনের অধীনে গবেষণা করেন, যার লক্ষ্য ছিল অর্থনীতি ও বিশ্বপ্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝা।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরপর তিনি দেশে ফেরেন এবং নতুন দেশ গঠনে অংশ নেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ উদ্ভাবন পদ্ধতির জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এই ক্ষুদ্রঋণ বলতে ১০০ ডলারের কম বোঝায়। যেসব কোম্পানি ছোট আকারে ঋণ দেয়, দরিদ্রদের শোষণ করতে তারা অতিরিক্ত সুদ নিয়ে থাকে বলে সমালোচনা আছে। কিন্তু অধ্যাপক ইউনূস দেখিয়েছেন, কীভাবে ক্ষুদ্র ঋণ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করলে সমাজের সবচেয়ে দরিদ্রদের জীবনও বদলে দেওয়া যায়।

১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি ড. ইউনূস একটি নিরীক্ষা চালান যে, ঋণ পরিশোধের উপায় কী হতে পারে এবং ঋণগ্রহীতারা কীভাবে সুবিধা পেতে পারে। তিনি একটি মডেল তৈরি করেন। সে অনুযায়ী নারীদের ব্যবসার উন্নতির জন্য ঋণ দেওয়া হয়। প্রথম ধাপে ঋণগ্রহীতাদের সবাই ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হন। ১৯৮৩ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি সারা বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ দেয়। ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণের এই মডেল ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী, যদিও এরও কিছু সমালোচনা আছে।

কিন্তু গ্রামীণের মতো একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা এবং ১৭ কোটি জনগণের দেশের সংস্কারে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। বাংলাদেশে যে প্রশ্নটি সবাই করছে তা হলো, শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী ড. ইউনূস দুর্নীতির অবসান, নাগরিক অধিকার রক্ষা, কর্মসংস্থান ও শিক্ষার সমান সুযোগ এবং বিক্ষোভে নিহতদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবেন কিনা।

কানেকটিকাটের নিউ হ্যাভেনের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ মুশফিক মোবারক বলছেন, আগস্ট বিপ্লবের আগে বাংলাদেশের পুলিশ, সিভিল সার্ভিস, বিচার ব্যবস্থার বড় অংশ, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং এমনকি ব্যাংকগুলোও ক্ষমতাসীনদের অংশে পরিণত হয়েছিল। ড. ইউনূস ও শিক্ষার্থীরা—যাদের কয়েকজন অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভায়ও আছেন—সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছে।

কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির গবেষণা পরিচালক ফৌজিয়া সুলতানা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দ্রুত হয় না, এটি জটিল ও ধীর প্রক্রিয়া। আরেকটি বিষয় হলো, অনেকেই এখনই পরিবর্তন দেখতে চান। আবার অনেকে 'তত্ত্বাবধায়ক' ভূমিকায় থাকা অধ্যাপক ইউনূস অনির্বাচিত বলে তার সরকারকে সংস্কারের উপযুক্ত বলে মনে করেন না।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ইউনূসের সফলতা নির্ভর করবে অনেকাংশে শিক্ষার্থীদের ওপর, যারা তাকে ক্ষমতায় এনেছে। এই শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা ২০১০ সালে আরব বসন্তের সময় মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা তরুণদের ভূমিকার মতোই। সেখানে অভ্যুত্থানগুলো সহিংসভাবে দমন করা হয়। এতে ওই অঞ্চল শুধু নয়, বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতার ঢেউ শুরু হয়। বাংলাদেশের গল্পটা অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। এখানে সেনাবাহিনী ও ড. ইউনূস উভয়ই শিক্ষার্থীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু একজন ব্যক্তির ওপর প্রত্যাশার পাহাড়।

গত সেপ্টেম্বরে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে এক সেমিনারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষার্থী প্রপ্তি তাপসী বলেন, 'আমরা পড়তে চাই, আমরা লিখতে চাই। আমরা পরীক্ষায় বসতে চাই, গবেষণা করতে চাই। রাষ্ট্রের কাজ রাষ্ট্রকেই করতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

7h ago