সেন্ট মার্টিনের কুকুর, দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও ভবিষ্যৎ সংকট

সেন্ট মার্টিনে কুকুরের অতিরিক্ত সংখ্যা পর্যটক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে ফেলতে শুরু করেছে। ছবি: প্রথম আলো থেকে নেওয়া

সেন্ট মার্টিনের বেওয়ারিশ কুকুরের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে খাবার দেওয়ার উদ্যোগ যারা নিয়েছেন, তাদের আন্তরিকতা এবং প্রাণীর প্রতি ভালোবাসার এ প্রকাশ নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এর মাধ্যমে প্রকৃতি এবং প্রাণীর প্রতি তাদের দায়িত্ব এবং মমত্ববোধের দিকটিই তুলে ধরেছেন তারা। এ ধরনের কাজ তাদের উদার মনের পরিচয় দেয় এবং এই প্রচেষ্টা সবার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মহৎ উদ্যোগটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের একমাত্র এই প্রবাল দ্বীপটির বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। হতে পারে মারাত্মক ঝুঁকির কারণ। কারণ খাবার দেওয়ার এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে 'প্রকৃতির ভারসাম্য' সম্পর্কে সঠিক কোনো জ্ঞান ছাড়াই।

প্রকৃতির অন্যতম প্রধান নীতি হলো সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট—অর্থাৎ যোগ্যতমরাই এখানে টিকে থাকবে। কুকুর সেন্ট মার্টিনের শীর্ষ শিকারি (top predator)। প্রাকৃতিক খাদ্য সরবরাহ যখন কমে আসে, তখন শিকারির সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পায়। কিন্তু খাবার সরবরাহ করে তাদের জীবনচক্রে কৃত্রিম হস্তক্ষেপ করলে শিকারির সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।

যখন আপনি কুকুরদের খাওয়ান, তখন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলাফল হিসেবে, শিকারির সংখ্যা প্রকৃতির চাহিদার তুলনায় বেড়ে যায়। এর প্রভাব সরাসরি সেই মার্টিনের সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন এবং ডিম পাড়ার প্রক্রিয়ার ওপর পড়ে।

সেন্ট মার্টিন একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ; যেখানে সমুদ্র এবং স্থলজ জীববৈচিত্র্য একসঙ্গে মিশে একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছে। এখানে খাদ্যশৃঙ্খল একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

দ্বীপের পানির নিচে থাকে কোরাল রিফ, যা প্রচুর সামুদ্রিক প্রাণীর আশ্রয়স্থল। কোরালের আশপাশে ছোট মাছেরা ঘোরাফেরা করে, যা বড় মাছের জন্য খাদ্য। এই বড় মাছেরা আবার দ্বীপের কাছাকাছি পাখি, শিকারি প্রাণী, এমনকি মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে, দ্বীপে সামুদ্রিক কচ্ছপ আসে ডিম পাড়তে। কচ্ছপের ডিম এবং বাচ্চা শিকার করে স্থানীয় কিছু বন্য প্রাণী। কচ্ছপগুলো বড় হলে তারা সমুদ্রের সামুদ্রিক আগাছা (seagrass) খেয়ে পরিষ্কার রাখে। এই সামুদ্রিক আগাছা পরিষ্কার না থাকলে সমুদ্রের নিচের পরিবেশ দূষিত হয় এবং কোরাল রিফের বৃদ্ধিতে বাধা পড়ে। কচ্ছপের সংখ্যা কমে গেলে আগাছার নিয়ন্ত্রণহীন বৃদ্ধি ঘটে। অতিরিক্ত আগাছা কোরাল রিফের ওপর জমা হয় এবং কোরালের সূর্যালোক গ্রহণ বাধাগ্রস্ত করে। সূর্যের আলো ছাড়া কোরালগুলো  সালোকসংশ্লেষণ  করতে পারে না, ফলে তারা ধীরে ধীরে মরে যায়। কোরাল রিফ মরে গেলে ছোট মাছেদের বাসস্থান হারিয়ে যায়। ছোট মাছ কমে গেলে বড় মাছের খাদ্যের অভাব হয়। বড় মাছের সংখ্যা কমে গেলে পাখি এবং অন্যান্য শিকারি প্রাণীর খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। কোরাল রিফ ধ্বংস হওয়া মানে পুরো দ্বীপের বাস্তুতন্ত্র  ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কোরাল রিফ সমুদ্রের ঢেউ থেকে দ্বীপকে রক্ষা করে। এটি না থাকলে সেন্ট মার্টিনে ভূমিক্ষয় এবং জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি বাড়ে।

এই পুরো চক্রটি সঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রাকৃতিক শিকারি-শিকারের মধ্যকার ভারসাম্য থাকা জরুরি। কিন্তু কুকুরের সংখ্যা বেড়ে গেলে এই ভারসাম্য ভেঙে যায়।

কচ্ছপের প্রজনন মৌসুমে কুকুরের অতিরিক্ত সংখ্যা একটি বড় হুমকি। এতে সৈকতে ডিম পাড়তে আসা দুর্বল কচ্ছপগুলোর ওপর আক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ে। যদি কচ্ছপগুলো ডিম পাড়তে সক্ষমও হয়, তাহলেও কুকুরের কারণে ডিমের নিরাপত্তা থাকে না। ফলে সামুদ্রিক কচ্ছপের বংশবিস্তারের প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়ে।

কচ্ছপের ডিম ও বাচ্চা ইকোসিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কচ্ছপের সংখ্যা কমে গেলে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

এদিকে কুকুরকে খাবার সরবরাহের প্রক্রিয়া কতদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। বাজেট কিংবা প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সেই তো আবার খাবারের ঘাটতি দেখা দেবে। কিন্তু ততদিনে দেখা যাবে কুকুরের সংখ্যা আরও বেড়েছে।

এর পরিণতিতে কুকুরগুলো ক্ষুধার্ত হয়ে আরও আগ্রাসী হবে। এরা কচ্ছপ, স্থানীয় পাখি এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীর ওপর আক্রমণ করবে। স্থানীয় ইকোসিস্টেমে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি হবে। 

এভাবে কুকুরের নিয়ন্ত্রণহীন সংখ্যা বৃদ্ধি স্থানীয় বায়োডাইভারসিটি ধ্বংসের কারণ হতে পারে। শীর্ষ শিকারি হিসেবে তারা অন্য প্রাণীদের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলে। খাদ্য সরবরাহের আগে এই বিষয়গুলো কি বিবেচনা করা হয়েছে? 

কুকুরকে নিয়মিত খাওয়ানোর ফলে তাদের স্বভাব পরিবর্তিত হবে। তারা খাদ্যের জন্য মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যখন খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে, তখন তাদের নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হবে।

সেন্ট মার্টিনে কুকুরের অতিরিক্ত সংখ্যা পর্যটক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে ফেলতে শুরু করেছে।  অদূর ভবিষ্যতে এটি খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং স্থানীয়দের জীবিকার ওপর সরাসরি আঘাত হানতে পারে।

পর্যটকরা যখন খোলা জায়গায় খাওয়ার আয়োজন করেন, কুকুরগুলো খাবারের জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। অনেক কুকুর একসঙ্গে খাবারের জন্য আক্রমণাত্মক আচরণ করলে তা ভীতি এবং অস্বস্তি তৈরি করবে।

পর্যটকরা একটি শান্ত ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রত্যাশা করেন। কুকুরের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাদের দ্বারা জায়গায় জায়গায় ময়লা ও আবর্জনা ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা পরিবেশের সৌন্দর্যহানি ঘটায় এবং পর্যটকদের অভিজ্ঞতাকে নেতিবাচক করে।

সেন্ট মার্টিনের অনেক পরিবার মুরগি, হাঁস, ছাগল ইত্যাদি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কুকুরের সংখ্যা বেশি হলে, তারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় এই প্রাণীগুলোর ওপর আক্রমণ করতে পারে। এর ফলে স্থানীয়রা অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। পোষা প্রাণী রক্ষায় পরিবারগুলোকে বাড়তি সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হতে পারে।

স্থানীয় লোকজন নিজেদের ব্যবহারের জন্য খাবার সংগ্রহ করেন। কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা আবর্জনা বা ময়লা খুঁজতে গিয়ে স্থানীয়দের খাদ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। এতে এলাকাবাসীর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হতে পারে।

কুকুরের মাধ্যমে জলাতঙ্ক এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে। কুকুরের সংখ্যা বেড়ে গেলে সংক্রমণের আশঙ্কাও বাড়ে, যা স্থানীয়দের কিংবা পর্যটকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে।

প্রকৃতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভারসাম্য বজায় রাখে। শিকারি ও শিকারের সংখ্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষ যখন এই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে, তখন ইকোসিস্টেম ভারসাম্য হারায়।

ধরা যাক, এই প্রকল্প অনেকদিন টেনে নিয়ে গেলে সেন্ট মার্টিনের সব কুকুর বেঁচে গেল। সংখ্যা আরও বাড়ল। এর প্রতিক্রিয়ায় বায়োডাইভারসিটির যে সমস্যা তৈরির শঙ্কা থেকে যায় তা সমাধানের পথ কি? কুকুরকে খাবার দিলে এর অভ্যাসে যে পরিবর্তন আসবে ভবিষ্যৎ ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান কি? এভাবে খাবার দেওয়া শুরু করার আগে কি কোনো প্রানী বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামত নেওয়া হয়েছে, যারা সেন্ট মার্টিন সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানেন।

শহরের কুকুরকে খাবার দেওয়া এবং সেন্ট মার্টিনের অর্ধ বুনো কুকুরকে খাবার দেওয়ার মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে; যা পরিবেশগত, সামাজিক এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের দিক থেকে আলাদা। এই পার্থক্যগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কেন সেন্ট মার্টিনের কুকুরকে খাবার দেওয়া বেশি সমস্যাজনক।

বন্যপ্রাণীকে তাদের নিজস্ব পরিবেশে বাঁচতে দিন। প্রকৃতি নিষ্ঠুর হতে পারে, কিন্তু সেটিই তার নিয়ম। মানুষের অযথা হস্তক্ষেপ প্রকৃতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। 

বুনো প্রাণীকে সাহায্য করার অর্থ তাদের খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা নয়। প্রকৃতির নিয়ম মেনে তাদের বাঁচতে দেওয়াটাই সঠিক পন্থা। 

এক্ষেত্রে আমাদের উচিত কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়া প্রকৃতিকে তার নিজের নিয়মে চলতে দেওয়া। প্রকৃতিগত কারণে কোনো প্রজাতি বিলুপ্ত হলে তা মেনে নেওয়া, কিন্তু মানুষের কারণে কোনো ইমব্যালেন্স তৈরি না হওয়ার ব্যবস্থা করা। সঠিক সংরক্ষণ কৌশল তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে প্রকৃতি ও প্রাণি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া।

ইরফান উদ্দিন: বন্যপ্রাণ সংরক্ষক ও সাবেক উদ্ধার কর্মী

Comments

The Daily Star  | English

Air freight capacity to increase

The move comes as Bangladesh's garment exporters face a major challenge in handling urgent international shipments after India abruptly closed a widely-used air cargo transhipment route

9h ago