রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের এই বিরল সুযোগ কি এবার কাজে লাগাবো?

চার সংস্কার কমিশন প্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস। ছবি: পিআইডি
চার সংস্কার কমিশন প্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস। ছবি: পিআইডি

এটাই হতে পারে দেশের মানুষের জন্য ড. ইউনূসের সবচেয়ে স্থায়ী অবদান। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে তিনি দরিদ্রদের দারিদ্র্যের শৃঙ্খল ভাঙার সুযোগ করে দিয়েছেন। এবার তিনি বাংলাদেশকে দিচ্ছেন এক বিরল সুযোগ, যার মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্র, সমতা, ন্যায়বিচার ও সহনশীলতার পথে এগিয়ে যেতে পারব। তিনি দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কারের সুযোগ তৈরি করেছেন, যা গত ৫৪ বছরে আমরা করতে পারিনি।

প্রধান উপদেষ্টা ও তার টিমকে এই মহান কাজের জন্য অভিনন্দন জানাই। একইসঙ্গে আমরা গণঅভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের একটি অংশ এবং দেশের আপামর জনগণকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাই, যারা এই সংস্কারের দুয়ার খুলে দিয়েছে।

একটি গণতান্ত্রিক ও সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রথম সুযোগটি আমরা পেয়েছিলাম ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে। দ্বিতীয় সুযোগটি এসেছিল জেনারেল এরশাদের পতনের পর, যখন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে সমন্বিত গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা দুটো সুযোগই হারিয়েছি।

এবার সুযোগটি এনে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তাদের গণআন্দোলনই মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। জাতি গঠনে তাদের ভূমিকা নতুন নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশের দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ষাটের দশকে সামরিকবিরোধী আন্দোলনে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা ছিল সর্বোচ্চ গৌরবময়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তারা ছিলেন সম্মুখ সারিতে।

শেখ হাসিনার পতনের পর তৎক্ষণাৎ নির্বাচনের পথে না গিয়ে একটি আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করা ছিল সঠিক ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। 'সংস্কার কমিশন' গঠনের ধারণাটি ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। কোন কোন জায়গায় মনোযোগ দিতে হবে সেটাও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কমিশনগুলোর প্রধান হিসেবে যাদের মনোনীত করা হয়েছে তারাও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো সংস্কার কমিশনেই প্রধান হিসেবে নারী না থাকাটা একটি বড় ত্রুটি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা তাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাক্ষ্য দেয়।

১৫ জানুয়ারি জমা দেওয়া চারটি কমিশনের প্রতিবেদন প্রাথমিক বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে, সুপারিশগুলো বাস্তবধর্মী। যদিও কিছু সুপারিশের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, সেখানে সুস্পষ্ট বিচার-বিবেচনার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে আবেগ।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুইবারে সীমিত করা, জাতীয় সংবিধান পরিষদ গঠন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনার সুপারিশগুলো সমর্থন করি। কিন্তু, চার বছর পরপর জাতীয় নির্বাচন করা হলে সেটার অপ্রত্যাশিত প্রভাব পড়তে পারে। কেননা, এর ফলে একটি নির্বাচিত সরকার পরিকল্পনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কম সময় পাবে। এ ছাড়া, নির্বাচন আয়োজন অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া এবং এর জন্য অনেক বড় লজিস্টিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন, যা আমাদের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে।

নির্বাচন ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার অপরিহার্য বিষয়। তবে আমরা পুলিশ সংস্কারের ওপর বিশেষ জোর দিতে চাই। কারণ, আমাদের মতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অপব্যবহারের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত করা হয়েছে পুলিশকে। ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (আইটিজেপি) এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের (টিজিআই) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কীভাবে আমাদের পুলিশকে নিষ্ঠুর, অমানবিক ও রক্তপিপাসু বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে আমাদের পুলিশ বাহিনীকে জনবিরোধী প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণরূপে জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা কতটা জরুরি।

তবে সবচেয়ে কঠিন কাজ হবে তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা। দীর্ঘদিন ধরে তাদের শেখানো হয়েছে আন্দোলনকারীদের ঘৃণা ও প্রতিবাদকারী প্রত্যেককে 'শত্রুজ্ঞান' করতে হবে। মারধর বা গুলি চালিয়ে আহত বা হত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায়ে গণজমায়েত নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ তাদের নেই।

এই চারটি কমিশনের সুপারিশ এবং ভবিষ্যতে যে সুপারিশগুলো আসবে সেগুলো অবশ্যই জাতীয় আলোচনার বিষয় হতে হবে। প্রথমই নিশ্চিত করতে হবে, এই প্রস্তাবনাগুলো থাকবে উন্মুক্ত। এ নিয়ে মতামত প্রকাশের কারণে কাউকে কোনো 'ট্যাগ' দেওয়া যাবে না। অন্যথায় আন্তরিক আলোচনার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হবে।

বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা যথাযথভাবেই রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এর পাশাপাশি চিন্তাবিদ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিদের এই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। গণমাধ্যমের উচিত, তাদের পাঠক ও দর্শকদের কাছে এগুলো পৌঁছে দেওয়া এবং এ বিষয়ে আলোচনার গভীরতা ও বিস্তৃতি বাড়ানোর চেষ্টা করা।

রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ শাসন করেছে মূলত দুটি দল—আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যদিও ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের কিছু মিত্র দলও ছিল। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে আমরা হয়তো ভুলে যেতে পারি যে এরশাদের পতনের পর গত ২৫ বছরের মধ্যে বিএনপিও আমাদের ১০ বছর শাসন করেছে।

১৯৯১ থেকে ২০০৬ সালের সময়কালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েরই প্রধান ভুল হচ্ছে, তারা সংসদকে 'জনগণের ভবন' বিবেচনা না করে বরং সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসেবে শাসক দলেরই একটি অংশ মনে করেছে। বাস্তবতা হলো, বিরোধী দল অল্প সংখ্যক সদস্য নিয়ে হলেও সংসদে ভিন্নমত প্রকাশের একটি ভালো সুযোগ পেত। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা ছিল সংসদ বয়কট করা। এটি সবসময় শুরু হয়েছে কয়েক ঘণ্টার ওয়াকআউট দিয়ে, এরপর কয়েক দিনের জন্য বয়কট, তারপর কয়েক সপ্তাহ-মাসের জন্য বয়কট এবং সবশেষে পদত্যাগ।

সংসদীয় সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে কাজ করার অভিজ্ঞতার অভাব আমাদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ, যা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আমাদের প্রায় ছিলই না। বিরোধী দলকে 'ছায়া সরকার' বিবেচনা করার ধারণা এবং সেই অনুযায়ী ক্ষমতার কাঠামোতে তাদের রাখার পরিকল্পনা শাসক দলের চিন্তাধারায় ছিল না।

এর বিপরীতে বিরোধী দল মনে করত, সংসদে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করে সরকারকে অকার্যকর করে তোলাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এর ফলে পুরো ব্যবস্থাটি ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, লাগাতার ও অযৌক্তিক হরতালে জনগণের কী পরিমাণ ভোগান্তি হয়েছে এবং অর্থনীতির কত ক্ষতি হয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টারে অসংখ্য প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বিরোধী দলকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে শাসক দলকে। সেইসঙ্গে বিরোধী দলকেও অনুরোধ জানানো হয়েছে সংসদ বয়কট না করতে। কিন্তু সেগুলো কোনো কাজেই আসেনি। যার ফলস্বরূপ সংসদ, সংসদীয় ব্যবস্থা এবং শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র ক্রমেই দুর্বল হয়েছে।

এতগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার নিয়ে আলোচনার মাঝে ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোরও সংস্কার জরুরি।

ড. ইউনূসের 'ঐকমত্য কমিশন' গঠনের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ চালানোই হলো সামনে এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে গ্রহণ করা। তাদের প্রতি আমাদের আহ্বান, তারা যেন তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে; যুক্তি ও তথ্য দিয়ে আলোচনা করে এবং শেষ পর্যন্ত একটি ঐকমত্যে পৌঁছায়।

এই কাজটি সম্পন্ন হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে জনসমক্ষে অঙ্গীকার করতে হবে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত যেকোনো দল তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে এবং নতুন সংসদে প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে সংবিধান ও প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন করে এগুলো আমাদের শাসন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করবে।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Disrupting office work: Govt employees can be punished within 8 days

The interim government has moved to amend the Government Service Act-2018 to allow swift disciplinary action against its employees who will be found guilty of disrupting official activities.

7h ago