সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি বিপন্নপ্রায়

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন যুগ যুগ ধরে উপকূলীয় মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। এই বন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষকে আগলে রাখে।
সুন্দরবনের প্রতি এই ভালোবাসার স্বীকৃতি দিতে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে 'সুন্দরবন দিবস' হিসেবে পালন করে আসছে। আজ পালিত হচ্ছে ২৫তম সুন্দরবন দিবস।
সুন্দরবনের ইমপ্যাক্ট জোন হিসেবে পরিচিত খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনার ১৭টি উপজেলায় দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাইকেল র্যালী, গণস্বাক্ষর অভিযান, মানববন্ধন, আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা প্রভৃতি।
এই দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় 'বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসুন'।
সরকার সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' (ইসিএ) ঘোষণা করলেও গত এক দশকে সেখানে গড়ে উঠেছে অন্তত ৬০টি ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট কারখানা, এলপি গ্যাস প্লান্ট, অয়েল রিফাইনারি, খাদ্য গুদামসহ নানা স্থাপনা। এসব শিল্প-কারখানার বর্জ্য সুন্দরবনের পানি ও মাটিকে দূষিত করছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি-শিল্প-পাট ও পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মী সুতপা বেদজ্ঞ বলেন, 'সুন্দরবনে বিষ দিয়ে যারা মাছ শিকার করছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। খুলনায় একটি পরিবেশ আদালত স্থাপন করতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া, সুন্দরবন রক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে জাতীয়ভাবে "সুন্দরবন দিবস" ঘোষণা করা জরুরি।'
তিনি বলেন, 'শুধু সচেতনতা নয়, কার্যকর আইন প্রয়োগ, পরিবেশবান্ধব পর্যটন, দখল ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং বন সংরক্ষণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই সুন্দরবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকে থাকবে।'
গত কয়েক বছরে সুন্দরবনে পর্যটকদের আনাগোনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। পর্যটন ব্যবসায়ীরা তাই এ খাতে বিনিয়োগ করছেন। গত ছয়-সাত বছরে বিলাসবহুল ২৯টি নতুন নৌযান যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটিতে সুইমিংপুলসহ তিন তারকা মানের সুবিধাও রয়েছে। পর্যটন ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, সুন্দরবনের পর্যটনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তারা।
সরকারিভাবে ২০১৪ সালে সুন্দরবন ভ্রমণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও তা মানা হচ্ছে না। এখন পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ৩০টির বেশি নৌযান সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে অবস্থান করে। প্রকৃতিবান্ধব পর্যটনের পরিবর্তে চলছে উচ্চ শব্দে সংগীত বাজানো ও পিকনিকের আয়োজন। এতে বন্যপ্রাণীগুলো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল ধ্বংসের মুখে পড়ছে। এসব নৌযান আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত। প্রায় প্রত্যেকটিতে ২০ থেকে ২৫টির বেশি এসি রয়েছে। নিয়ম-নীতি না মেনে রাতে এসব জলযানে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন লাইট ব্যবহার করা হয়, যা সুন্দরবনের প্রাণীকুলের স্বাস্থ্যসম্মত আবাসনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, 'অভয়ারণ্যে যত্রতত্র প্রবেশ বন্ধ করা দরকার। নিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিশ্চিত করা গেলে বন ও বন্যপ্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমবে। নৌযানের ইঞ্জিনের শব্দ ও হাইড্রোলিক হর্ন বন্যপ্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলযানের পাখার আঘাতে ডলফিন মারা পড়ছে, আর তেল ও রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে বনের পানি ও মাটি।'
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পশুর নদসহ সুন্দরবনের প্রধান নদীগুলো দিয়ে প্রতিদিন ৩৪৫টি দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচল করে। গত ১০ বছরে এসব নদ-নদীতে অন্তত ২৬টি জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে ফার্নেস অয়েল, কয়লা, সারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়েছে পানিতে। এতে শুধু জলজ প্রাণীরাই নয়, পুরো বনপ্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এজেডএম হাসানুর রহমান বলেন, 'বন্যপ্রাণী ও বনজ সম্পদ পাচার রোধে নদী-খালগুলোর মুখে টহল জোরদার করা হয়েছে। এখন স্মার্ট প্যাট্রোলিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং বন অপরাধীদের ধরতে র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ড যৌথভাবে কাজ করছে।'
Comments