মানুষ কেন অবলা প্রাণীকে কষ্ট দেয়: মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

মানুষ কেন অবলা প্রাণীকে কষ্ট দেয়
ছবি: জয়িতা তৃষা

বাংলাদেশে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার শুরুটা হয় শিশুকাল থেকে। অন্যের সঙ্গে আচরণ কেমন হবে তা শেখার মধ্য দিয়ে, কখনও সামাজিক রীতিনীতির মধ্য দিয়ে এবং কখনও মানসিক ব্যাধি থেকে। শিশুরা তার চারপাশ থেকেই শেখে, সে যদি নির্যাতনমূলক পরিবেশে বড় হয় তাহলে সেসবই শেখে। সামাজিক চাপও অনেক সময় এ ধরনের আচরণকে স্বাভাবিক করে তোলে এবং মানসিক সমস্যাগুলো বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। অবলা প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধের জন্য যথাযথ শিক্ষা, আইনের প্রয়োগ এবং গণমাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে সহানুভূতি ও সন্তান লালন-পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ানো প্রয়োজন।

খুব পরিচিত একটি দৃশ্যের বর্ণনা দিই। ঢাকার বিশৃঙ্খল সড়কে থেঁতলানো পা আর চোখভর্তি ভয় নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে একটি ছোট্ট কুকুরছানা। কিছুদূরেই কয়েকজন কিশোর-কিশোরী উল্লাস করছে, যারা কুকুরছানাটিকে ইটের টুকরো ছুঁড়ে মারছে আর ছানাটি চিৎকার করে পালাচ্ছে।

বাংলাদেশে এই ধরনের নিষ্ঠুরতার দৃশ্য খুব সাধারণ, আর এগুলো কখনো খবরের শিরোনামও হয় না। রাস্তার কুকুর থেকে শুরু করে বিড়াল, প্রত্যেকেই প্রতিদিন এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই কেন মানুষ অসহায় এই প্রাণীগুলোর ক্ষতি করতে বা তাদের কষ্ট দিতে চায়? এর পেছনে কারণ কী?

এর জবাব লুকিয়ে আছে মানুষের মনোজগতে। যা তার আচরণ, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ এবং সামাজিক রীতিনীতি দিয়ে তৈরি হয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতে, এর কারণগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এগুলো হলো জ্ঞানীয় শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা এবং মানসিক ব্যধি।

আমরা যা দেখি, তাই করি

শিশুরা তাদের আশপাশের পরিবেশ থেকে আচরণ শেখে। যদি শিশু এমন একটি পরিবারে বেড়ে ওঠে যেখানে পশুদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয় তারাও সেই আচরণই শেখে। তারা এই নিষ্ঠুর আচরণকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ব্যাখ্যা করে বলেন, 'একটি শিশু ঠিক ও ভুল সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয় তার আশপাশের পরিবেশ থেকে। যদি তারা নিজের পরিবার বা সমাজে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখে বড় হয়, তাহলে তারা এটিকে স্বাভাবিক আচরণ হিসেবেই গ্রহণ করবে, এমন সম্ভাবনাই বেশি। সমমর্মিতা শেখাও গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশুকে যদি চারপাশে থাকা পশু বা অন্য মানুষের আবেগ বুঝতে, তাদের যত্ন নিতে শেখানো না হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার ভেতর সহানুভূতি গড়ে উঠবে না।'

অনেক বাংলাদেশি পরিবারে পথের বিড়াল-কুকুরকে বাড়তি উপদ্রব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি অনেক বাবা-মা আছেন যারা রাস্তার কুকুক-বিড়ালদের লাঠি বা পাথর দিয়ে আঘাত করে তাড়িয়ে দিতে সন্তানদের উৎসাহ দেন। যার ফলে, এই শিশুরা পশুদের বিষয়ে যত্নশীল না হয়েই বেড়ে ওঠে এবং নিষ্ঠুরতা তাদের চরিত্রের মধ্যে গেঁথে যায়।

নিয়ম মেনে চলা

অনেক মানুষই আছে যারা স্বাভাবিকভাবেই প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, কিন্তু অনেক সময় সামাজিক চাপে তাদের নিজেদের সেই অনুভূতি দমন করতে হয়। যদি একটি সমাজ সম্মিলিতভাবে প্রাণীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে তাহলে যেকোনো সাধারণ মানুষ একই আচরণ করার জন্য চাপ অনুভব করতে পারেন। বরং বিপরীত আচরণ করা তার জন্য অস্বস্তির কারণ হয়।

ডা. হেলাল বলেন, 'সামাজিক রীতিনীতির কারণে প্রাণীদের প্রতি সমমর্মী একজন মানুষকে প্রকাশ্যে তার অনুভূতি ব্যক্ত করতেও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হতে পারে। একটি সমাজে যদি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে দেখা হয় তাহলে সমমর্মী কোনো ব্যক্তির সেখান থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়ানো খুব কঠিন।'

এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হতে পারে, ঢাকার রাস্তার কুকুরদের গণহারে হত্যার ঘটনা। কুকুরের বংশবৃদ্ধি ঠেকাতে বা তাদের সংখ্যা কমাতে অনেক পৌরসভাই বিষ প্রয়োগ বা অন্য কোনো ধরনের অমানবিক পন্থা বেছে নেয়। ফলে সরকারই যখন নিষ্ঠুরতাকে স্বাভাবিক করে তোলে তখন নাগরিকদের কাছে এই বার্তা যায় যে, প্রাণীদের ক্ষতি করা যেতেই পারে।

মানসিক রোগ এবং আঘাত

কিছু মানুষ আছেন যারা প্রাণীদের আঘাত করেন কারণ তারা গভীর কোনো মানসিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। শৈশবে যোগাযোগগত সমস্যা, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার এবং সিজোফ্রেনিয়াও কখনও কখনও মানুষকে নিষ্ঠুর করে তোলে।

ডা. হেলাল আরও বলেন, 'শৈশবের কোনো মানসিক আঘাত একজন মানুষের আচরণকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। একটি শিশু যে কিনা সহিংসতা বা অবহেলার শিকার হয়েছে, তার নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। শৈশবে পাওয়া সে সহিংসতা সে অন্য মানুষ বা অন্য প্রাণীদের ওপরও চাপিয়ে দিতে চায়।'

গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক মানুষ যারা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকেন তাদের নিষ্ঠুরতার শুরুটা হয় প্রাণীর প্রতি সহিংস আচরণের মধ্য দিয়ে। এর অর্থ ভবিষ্যতের সহিংসতা রোধে শুরু থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি।

প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধে কী করা যায়?

নিষ্ঠুরতা রোধের প্রথম পদক্ষেপ হলো বাড়িতে সহানুভূতিশীল পরিবেশ গড়ে তোলা।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণের শুরুটা হয় ঘর থেকে। অভিভাবকদের উচিত শিশুর সামনে পশু-পাখিদের প্রতি সম্মানজনক আচরণের উদাহরণ তৈরি করা। সেইসঙ্গে শিশু যেন পোষা প্রাণী ও রাস্তার পশুদের প্রতি সমমর্মী হয় সে বিষয়টি তাদের বোঝানো, তাদের সামনে ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করা।'

পশু কল্যাণ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্কুলগুলোর উচিত পাঠ্যসূচীতে প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং পশু পালন করলে তার বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা। সেইসঙ্গে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা থেকে কীভাবে বড় ধরনের সহিংসতার সৃষ্টি হতে পারে, সে সম্পর্কেও শিশুদের জানানো উচিত।

জনসাধারণের মনে এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা সৃষ্টিতে সাহায্য করতে পারে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও বিনোদন অঙ্গন। সেইসঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন যেন পথের পশুদের প্রতি সাধারণ মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনা যায়।

ডা. হেলাল বলেন, 'পাবলিক ফিগার যেমন অভিনেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অথবা ব্যবসায়ী নেতারা সাধারণ মানুষের মনোজগতের ওপর বিরাট প্রভাব রাখতে পারেন। যদি তারা সক্রিয়ভাবে প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন তাহলে সাধারণ মানুষও তাদের অনুকরণ করবেন।"

এটা মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার বিষয়ে আইন থাকলেও তার বেশিরভাগই পুরোনো এবং সেগুলো খুব কমই প্রয়োগ করা হয়। আইনের শক্তিশালী প্রয়োগ, পশুর প্রতি সহিংসতা রোধে কমিউনিটি বেইসড তথ্য আদান প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া গেলে সহিংসতার হাত থেকে প্রাণীদের রক্ষা করা সম্ভব।

সব মিলিয়ে, মানুষ হোক আর অন্য প্রাণী, এদের কেউই অন্যের হতাশা, বিনোদন বা অজ্ঞতার জন্য কষ্ট পেতে পারে না। সমাজ হিসেবে আমাদের অবশ্যই প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পশু-পাখির প্রতি উদাসীনতার পরিবর্তে ভালোবাসা নিয়ে বড় হবে।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English
Yunus goes to Vatican for Pope Francis funeral

Yunus lands in Rome

The chief adviser is visiting the Vatican to attend Pope Francis' funeral

18m ago