মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক: মেরামতে ব্যয় ৫৪ কোটি টাকা, ৬ মাসও টেকেনি

নারায়ণগঞ্জ, মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক, সওজ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ,
শিল্পাঞ্চল ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে ওঠায় আঞ্চলিক মহাসড়কটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম ব্যস্ত একটি সংযোগ সড়কে পরিণত হয়েছে। ছবি: সৌরভ আহমেদ সিয়াম/স্টার

নারায়ণগঞ্জের মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক মেরামতে ৫৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও তা ছয় মাসও টেকেনি। ১১ কিলোমিটার এ সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, পিচ উঠে গেছে। প্রায় সময়ই যানবাহন উল্টে সড়কের পাশে খাদে পড়ে ঘটছে হতাহতের ঘটনা।

অল্প সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটির বেহাল দশার জন্য ওজনসীমার অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই ভারী যান, বিশেষ করে সিমেন্ট কারখানার যান চলাচলকে দায়ী করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)।

পরিবহন মালিক ও সিমেন্ট কোম্পানির কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করে বিকল্প না থাকায় সড়কটি ব্যবহারের কথা জানিয়েছেন।

তিন দশক আগে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলাবাসীর যাতায়াতের সুবিধার্থে পুরাতন রেললাইনের উপর মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কটি তৈরি করা হয়। সাধারণত সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করত এ সড়কে। ২০২২ সালের অক্টোবরে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলে সড়কটির গুরুত্ব বেড়ে যায়। পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের দিকে চলাচলের জন্য এ সড়কটি অন্তত ৯ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে দেয়।

শিল্পাঞ্চল ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করায় আঞ্চলিক এ মহাসড়কটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম ব্যস্ততম সংযোগ সড়ক।

সওজ'র কর্মকর্তারা জানান, তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু এ সড়কের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিলে সড়কটি প্রশস্ত ও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১১ কিলোমিটারের সড়কে পিচ ঢালাই, চারটি কালভার্ট ও একটি সেতু নির্মাণে সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষদিকে সড়ক মেরামতের কাজ শেষ হয়।

স্থানীয়রা জানান, সড়কটি মেরামতের পর ৬ মাসের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ফাটল, গর্ত ও পিচ উঠে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে।

সরেজমিনে সড়কটির বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্ত দেখা যায়। অনেক জায়গায় বড় অংশজুড়ে সড়কের পিচ উঠে গেছে। এতে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। বিকল্প না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে এ সড়কেই নিয়মিত যাতায়াত করছে হচ্ছে স্থানীয়দের।

সড়কটির ক্ষতির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ওভারলোডেড সিমেন্ট কোম্পানির ট্রাক ও লরি চলাচল। বিশেষ করে রাতের বেলা এসব ভারী যানবাহন কোনো ধরনের ওজন নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলাচল করে, যা নতুন সড়কের স্থায়িত্ব কমিয়ে দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীরের দুইপাড়ে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ অংশে গড়ে উঠেছে শাহ, প্রিমিয়ার, ক্রাউন, মেট্রোসেম, আকিজ, সেভেন রিংসসহ দেশের বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদনকারী কারখানা। এসব সিমেন্ট কোম্পানির ভারী যানগুলো সাধারণত মোক্তারপুর-পঞ্চবটি সড়কে চলাচল করলেও ওই আঞ্চলিক সড়কটিতে নির্মাণকাজ চলায় বর্তমানে যানবাহনগুলো মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক হয়ে চলাচল করছে।

এছাড়া, সড়ক মেরামতে অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগও করেন স্থানীয়রা।

উপজেলার বন্দর রেললাইন এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ বাতেন বলেন, 'সড়কের কাজটা ভালো হয় নাই। মেরামতের পর ৬ মাসও টেকেনি সড়কটি। অনেক জায়গায় দেবে গেছে, গর্তের তো অভাব নাই। প্রায় সময়ই গাড়ি উল্টে যায়।'

সম্প্রতি এ সড়কের গর্তের কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার বাগবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. শাওন বলেন, 'গাড়ি উল্টে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যাওয়া এই সড়কের নিত্যদিনের ঘটনা। সন্ধ্যার পর এ সড়ক মরণফাঁদে পরিণত হয়।'

বন্দর থানা পুলিশ জানায়, গত ৬ মাসে এই সড়কে পাঁচটি বড় দুর্ঘটনার তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। তবে, এই সংখ্যা কয়েকগুণ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে শাহ সিমেন্টের একটি মিক্সার ট্রাক উল্টে সড়কের পাশে পড়ে গেলে চালক ও হেলপার গুরুতর আহত হন। পরদিনও আরেকটি ট্রাক একইভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়।

ওভারলোডেড ট্রাক

এ সড়কে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করেন সিএনজিচালক বাচ্চু মিয়া। তিনি বলেন, দিন-রাত প্রচুর ভারী লরি ও ট্রাক চলে এই সড়কে, যারা নিয়মের তোয়াক্কা না করেই দ্রুতগতিতে পণ্য পরিবহন করে। এত ওজন সহ্য করতে না পেরে রাস্তা বসে যাচ্ছে।

গত ১ মার্চ দুপুর ১২টা থেকে ১৫ মিনিটে এ সড়কে ২১টি পণ্যবোঝাই ট্রাক চলাচল করতে দেখা গেছে। যার অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন কোম্পানির সিমেন্টবাহী ট্রাক। রাতে এ সড়কে যান চলাচল আরও বেড়ে যায়।

এ সড়কে ভারী যান চলাচল বন্ধের উদ্যোগও নিয়েছিল সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ অফিস। গত ৭ থেকে ৯ ডিসেম্বর পুলিশের সহযোগিতায় দুই শতাধিক ভারী যানের কাগজপত্র যাচাই করে সওজ। এতে, ওজনসীমার চেয়েও ১০ থেকে ২০ টন অতিরিক্ত পণ্য বহনের সত্যতাও পান। পরে ওজনসীমার অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই গাড়িগুলো উল্টো পথে ঘুরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

তবে, পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন।

সওজে'র এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এটি আঞ্চলিক মহাসড়ক হলেও ওভারলোডেড ভারী যান চলাচলের উপযোগী নয়। আমরা সিমেন্ট কোম্পানিগুলো ও পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের যানবাহনে অতিরিক্ত পণ্য বহনে নিরুৎসাহিত করতে চিঠিও দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা এতে সাড়া দেননি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও জানেন।'

বর্ষা মৌসুম আসার আগেই সড়কটি মেরামতের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কিন্তু তা শুধু ওভারলেপ দিয়ে হবে না। বড় বরাদ্দ না আসলে মেরামতের পরও অল্প সময়ের মধ্যে পুরোনো অবস্থায় ফিরে আসবে।'

চরসৈয়দপুর ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি আসলাম সরকার বলেন, 'আমরা তো গাড়ি ভাড়া দেই। অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই তো করে যারা ভাড়া নেন তারা। এতে আমাদের কোনো হাত নেই। কিন্তু সারাদেশের সব সড়কেই তো অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যান চলছে। সরকার যদি কড়া নিয়ম করে তাহলে এ প্র্যাকটিসের পরিবর্তন হবে, নইলে না।'

যোগাযোগ করা হলে ওজনসীমার অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের বিষয়টি স্বীকার করেন শাহ সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার (রোড ট্রান্সপোর্ট অপারেশন) মনির উদ্দিন আহমেদও। পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়াতে ক্ষতি পোষাতে প্রতি যাত্রায় অতিরিক্ত পণ্য বহন করতে বাধ্য হন। শুধু সিমেন্ট কোম্পানি নয়, এ চর্চা সব পণ্যবাহী যানে চলে বলেও জানান তিনি।

'সড়কটির অবস্থা খুবই খারাপ, এরজন্য ভারী যানবাহনগুলোও কিছুটা দায়ি। কেননা, এত লোডের জন্য রাস্তাটা তৈরি হয়নি। কিন্তু আমরা তো নিরূপায় হয়ে এ সড়কটি ব্যবহার করছি। পঞ্চবটি-মোক্তারপুর সড়কটির কাজ শেষ হয়ে গেলে এ সড়কে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো কেন, কোন ভারী যানই ঢুকবে না।'

এ সড়ক মেরামতের জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে সিমেন্ট কোম্পানিগুলোও সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত বলেও জানান মনির।

সওজ'র নারায়ণগঞ্জ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহিম বলেন, 'সড়কটির বেহাল দশা নিয়ে আমরাও চিন্তিত। ওভারলোডেড গাড়ি এই সড়কে চলাচলের কথা ছিল না। কিন্তু ওভারলোডেড যান চলাচল থামানোও যাচ্ছে না। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সংস্কারের চিন্তাও আমরা করছি। কিন্তু সড়কটির দুইপাশে নিচুজমি থাকায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন।'

এদিকে, তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণের পর এ সড়কে যানবাহনের আধিক্য বেড়ে গেলে গত সরকারের আমলে সড়কটিকে ছয় লেনে রূপান্তরের পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়। তবে, ওই প্রকল্পের বিষয়ে নতুন কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানান এ প্রকৌশলী।

Comments

The Daily Star  | English

Election Roadmap: BNP unhappy as Yunus gives no specific timeline

The election must be held by December, as any delay could cause the situation to spiral out of control, the BNP said after a meeting with the chief adviser yesterday.

7h ago