পূর্ণি আয়মান: আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রথম বাংলাদেশি নারী রেসার

পূর্ণি আয়মান
ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক মোটরস্পোর্টের জগতে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন পূর্ণি আয়মান। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় টাইম অ্যাটাক রাউন্ডে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছেন তিনি। রেসিং জগতে তার এই অনুপ্রেরণামূলক যাত্রা বিশ্বব্যাপী রেসিং ট্র্যাকে নারীদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বাধাগুলোকে দূর করতে সাহায্য করেছে।

যে মুহূর্তে বাংলাদেশের মেয়ে পূর্ণি আয়মান আবুধাবির ইয়াস মেরিনা সার্কিটের ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করলেন, সে মুহূর্তে তিনি কেবল একটি রেস শেষ করলেন না, তৈরি করলেন ইতিহাস। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক কোনো মোটরস্পোর্ট ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই আয়োজনে আয়মানের অংশগ্রহণ কেবল গতি বা র‌্যাংকিংয়ে কততম হয়েছেন সেই বিষয় নয়। বিষয়টি প্রতিনিধিত্বের, অধ্যাবসায়ের এবং প্রথা ভাঙার। এমন একটি ক্ষেত্রে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন যেখানে বাংলাদেশের নারীরে খুব কমই অংশ নিতে দেখা যায়।

রিয়ার হুইল ড্রাইভ আনলিমিটেড ক্লাস রাউন্ডে আয়মান চালিয়েছিলেন টয়োটার জিটি এইটিসিক্স মডেল এবং এটি নিয়েই শেষ করেন চতুর্থ রাউন্ড। প্রতিযোগিতায় আলাদা পাঁচটি ক্লাসে অংশ নেয় ৩৫টি রেসিং কার। যার মধ্যে ছিল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পোরশে ও বিএমডব্লিউ গাড়িও। তবে প্রতিযোগিতায় সবাইকে ছাপিয়ে যেতে হবে, এমন কোনো লক্ষ্য ছিল না আয়মানের। তার চেয়ে বরং তিনি এটা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের নারীরাও অন্য অনেকের মতো আন্তর্জাতিক মোটরস্পোর্টে অংশ নিতে পারে।

গাড়ির প্রতি আবেগ

রেসিং কারের স্টিয়ারিংয়ের পেছনে বসার বহু আগে থেকেই আয়মানের গাড়ির প্রতি আগ্রহের সূত্রপাত।

তিনি বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই গাড়ি আমাকে মুগ্ধ করত। আমার বাবা ঘন ঘন গাড়ির মডেল পরিবর্তন করতেন। সেই থেকে গাড়ির প্রতি কৌতূহল আমার। সময়ের সঙ্গে এটা শখের চেয়ে বেশি হয়ে ওঠে। এটা এখন আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার প্রতি আবেগ-উত্তেজনা প্রতিদিনই বাড়ছে।'

আয়মানের প্রাথমিক কৌতূহল সময়ের সঙ্গে উচ্চাকাঙক্ষায় পরিণত হয়। এক সময়ের সাধারণ আগ্রহ পরিণত হয় গভীর রাতের গবেষণার বিষয়ে। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ শেষে যা আয়মানকে নিয়ে যায় প্রতিযোগিতার ময়দানে। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে মোটরস্পোর্টের দৃশ্যত কোনো অবকাঠামো নেই, তাও আবার নারীদের জন্য, সেখানে এতদূর যাওয়া নিঃসন্দেহে ছিল দারুণ চ্যালেঞ্জের।

উৎসাহ এবং প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ

আয়মানের রেসিং যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছেন অভিক আনোয়ার, যিনি এরই মধ্যে বাংলাদেশের অটোমটিভ জগতের চেনা নাম।

আয়মান বলেন, 'তিনি প্রায় আমাকে গাড়ি চালাতে দেখে উৎসাহ দিতেন। তিনি বলতেন, তুমি চমৎকার করে গাড়িগ চালাও, তোমার উচিত এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া সেসময় এসব উৎসাহ আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতেন। তার কথাতেই কেবল আনন্দের জন্য নয়, গাড়ি চালানোকে আমি গুরুত্বের সঙ্গে নিই।'

এই অনুপ্রেরণা থেকেই আয়মান শুরুতে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।

তিনি বলেন, 'আমরা দেশের বাইরে সঠিক প্রশিক্ষণের জায়গা খুঁজছিলাম। সেজন্য আমি আমার প্রথম সিমুলেটরটি কিনি, যাতে করে সরাসরি প্রশিক্ষণ নিতে যেতে পারি।'

রেসিং জগতে সিমুলেটর হলো এক ধরনের ভার্চুয়াল পরিবেশ। যেখানে চালক ট্র্যাকে রেস কার চালানোর অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। এর মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়ে এবং বিভিন্ন সেটআপ ও কৌশলে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা তৈরি হয়।

যখনই সব পরিকল্পনা গুছিয়ে এনেছিলেন আয়মান তখনই বিশ্বজুড়ে জারি হয় কোভিড-১৯ সতর্কতা। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে তাকে বাড়িতেই থাকতে হয় এবং সেসময় তিনি পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হন।

ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণ এবং বিশ্বজুড়ে রেসিং

সেসময় হাল ছেড়ে দেওয়ার বড়লে আয়মানের মনোবল যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। ২০২৪ সালে তিনি নতুন আরেকটি সিমুলেটরে বিনিয়োগ করেন এবং অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এএবি) আয়োজিত অনলাইন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন।

আয়মান বলেন, 'এই পর্যায়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেসময় আমি নিজের একটা প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে সক্ষম হই, রেসিং জগতের গতিবিধি বুঝতে এবং মনোযোগ তীক্ষ্ণ করতেও সমর্থ হই।'

ভার্চুয়াল রেসে খুব ভালো করছিলেন আয়মান, কয়েকটি ম্যাচে জিতেও যান।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই ট্র্যাকে নামার আগে দুবাইয়ের অটোড্রোম এবং ইয়াস মেরিনা এফ-ওয়ান সার্কিটেও গাড়ি চালিয়েছেন তিনি।

আয়মান বলেন, 'এখানে কয়েকজন প্রশিক্ষকের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, যা আমাকে ভার্চুয়াল জগত এবং সত্যিকারের রেস ট্যাকের মধ্যে সামঞ্জস্য করতে সহায়তা করেছে।'

বাধা ভেঙে নারীদের অনুপ্রেরণায়

আয়মানের কাছে তার এই মাইলফলবক কেবল ব্যক্তিগত নয়।

তিনি বলেন, 'এই জয় আমার ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে বেশিকিছু। এটা বাধা ভেঙে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প, অন্য নারীদের সামনে প্রমাণ করার গল্প যে, আপনি যদি কোনও কাজ ভালোবেসে করেন তাহলে তা আপনাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। এমনকি সেখানে পুরুষ আধিপত্য থাকলেও অধ্যাবসায় আপনাকে অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে।'

আয়মান বললেন, নারী চালকদের নিয়ে প্রায়ই অন্যরা সংশয় প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, 'কেবল রেসিং ট্র্যাকে নয়, পথেও গাড়ি নিয়ে বের হলে কিছু মানুষ আপনাকে নিয়ে কথা বলবে। যদি তাদের এসব নেতিবাচক কথা আপনি নিজের মনে নেন, তাহলে আপনিই পিছিয়ে পড়বেন। যদি আপনার স্বপ্ন থাকে অনেক বড়, তাহলে এসব কথাকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। যে যাই বলুক না কেন নিজের স্বপ্নের পথে চলতে হবে।'

স্থানভেদে মোটসস্পোর্টে নারী হিসেবে সহযোগিতা পাওয়ার জায়গাটি কতটা ভিন্ন সে সম্পর্কে জানতে চাইলে আয়মান বলেন, 'দুবাই খুবই অন্তর্ভূক্তিমূলক জায়গা। তবে সত্যি বলতে, হয়ত সেখানকার মানুষদের এটি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার মতো আবেগ নেই। ইউরোপের ক্ষেত্রে আবার বিষয়টি ভিন্ন। সেখানে আপনি অনেক নারী চালক দেখতে পাবেন এবং সেখানে বিষয়টি একেবারেই স্বাভাবিক।'

দীর্ঘমেয়াদে আয়মানের লক্ষ্য কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেসিং চালিয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশে বিশেষ করে নারীদের জন্য মোটরস্পোর্ট সংস্কৃতি বিকাশে সহায়তা করাই তার লক্ষ্য।

আন্তর্জাতিক ট্র্যাকে পূর্ণি আয়মানের অভিষেক খবরের শিরোনামের চেয়ে বেশি কিছু। এটি বরং একটি পরিবর্তনের পদক্ষেপ, যা সূক্ষ্ম কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি নারীরা জায়গা করে নিচ্ছেন আন্তর্জাতিক মোটরস্পোর্টের ট্র‌্যাকে। সময় নিয়ে, প্রস্তুতির মাধ্যমে নিজের ক্ষমতার ওপর ভর করে আয়মান এ পর্যন্ত এসেছেন। কিন্তু তিনি মনে করিয়ে দিতে চান যে, এই জগতে তিনি একমাত্র বাংলাদেশি হতে চান না।

তিনি বলেন, আমি মনে করি এটা কেবল শুরু। আশা করি দ্রুত আরও নারীরা এগিয়ে আসবেন।'

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Locals take it upon themselves to repair road

On Saturday, residents of the two villages began the work to turn the earthen road to a brick road

1h ago