ঢাকায় স্ট্যান্ড-আপ কমেডি যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল

স্ট্যান্ড- আপ কমেডি

বাংলা লোকগানের কথা থেকে শুরু করে মঞ্চের সংলাপ কিংবা টেলিভিশন নাটকের মজার অথবা ব্যঙ্গাত্মক সংলাপ- সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য হলো 'হাসি'। হাসি সংযোগ ও সমালোচনার মাধ্যম ছাড়াও আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে 'স্ট্যান্ড-আপ কমেডি'—অর্থাৎ একজন ব্যক্তি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সরাসরি দর্শকদের সামনে হাস্যরস পরিবেশন করবে এই ধারণাটি আমাদের সংস্কৃতিতে তুলনামূলক নতুন একটি বিষয়, যা ভিনদেশে বেশ প্রচলিত একটি বিনোদন মাধ্যম।

গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে একটি অস্পষ্ট ধারণা থেকে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি ধীরে ধীরে বিনোদনের নতুন মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে এই পরিবর্তন কীভাবে ঘটল। মানুষ স্ট্যান্ড-আপ কমেডিকে কীভাবে একটি নতুন শিল্পমাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর লুকিয়ে আছে এর পথিকৃৎদের গল্পে এবং সমাজে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলোর মধ্যে, যা এই মাধ্যমটির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলেছে।

স্ট্যান্ড- আপ কমেডি

ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সিতে কর্মরত ফেরদৌস উৎস কর্মব্যস্ত সপ্তাহ শেষে বন্ধুদের সঙ্গে ভালো সময় কাটাতে নিয়মিতভাবে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি শোতে চলে যান।

তিনি বলেন, 'প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে কমেডি শো দেখতে চলে যাই। একসঙ্গে হাসি আর আড্ডার মধ্য দিয়ে সারা সপ্তাহের চাপ দূর হয়ে যায় আর নতুন সপ্তাহটা খুব ভালোভাবে শুরু হয়।'

শুরু হলো যেভাবে

আপনি যদি কাউকে বলেন যে আপনি একটি কমেডি ক্লাব শুরু করছেন, তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? সম্ভবত বিদ্রূপের হাসি। ঠিক এটাই ঘটেছিল নাভিদ মাহবুবের সঙ্গে, যিনি বাংলাদেশের কমেডি জগতের একজন পথিকৃৎ।

তিনি যখন 'নাভিদস কমেডি ক্লাব (এনসিসি)' চালু করেন, তখন অনেকেই বিষয়টি সিরিয়াসলি নেননি। বর্তমানে তিনি এই ক্লাবের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

স্ট্যান্ড- আপ কমেডি

নাভিদ মাহবুবের কথা অনুযায়ী, এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের গোড়ার দিকে — তখন এই ধারণাটিই ছিল অনেকের কাছে অপরিচিত।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'আমরা যখন ২০১০ সালে এই ক্লাব শুরু করি, তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পারফর্মার খুঁজে পাওয়া। তখন খুব বেশি কমেডিয়ান ছিলেন না, আর নিয়মিত শো করতে হলে একটা নির্দিষ্ট লাইনআপ দরকার হতো।'

শুরুর দিকে শোগুলো ছিল অনিয়মিত, দর্শকসংখ্যা কম ছিল এবং বেশিরভাগ মানুষ ঠিকভাবে বিষয়গুলো বুঝতে পারতেন না। দুঃখজনকভাবে, এ সময়ে যে শিল্পীরা উঠে এসেছিলেন, তারা মূলত অতিরঞ্জিত বা নাটকীয় ধরনের হাস্যরসের ওপর নির্ভর করতেন এবং পশ্চিমা ধারার অনুপ্রেরণায় কাজ করতেন।

শুরুর দিকের প্রতিকূলতার কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টেলিকম বিশেষজ্ঞ থেকে খ্যাতিমান স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান বনে যাওয়া সামি দোহা বলেন, 'দেখুন, তখন পারফর্মেন্সগুলো মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল, আর শোগুলোও ছিল ছাড়া ছাড়া। দর্শকরা তখনো ঠিক বুঝতেন না স্ট্যান্ড-আপ কমেডি আসলে কী, আর পারফর্মারও ছিল হাতে গোনা। সবাই একে একটা শখ হিসেবে দেখত, পেশা হিসেবে না।'

এত সংগ্রামের মধ্যেও স্ট্যান্ড-আপ কমেডি এখন দর্শকদের মনে একটি জায়গা করে নিয়েছে। এর কারণ হল কিছু মানুষের অটুট মনোবল।

ঘুরে দাঁড়ানোর সময়

নাভিদ মাহবুবের মতে, ২০১০-এর দিকে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর আগমন স্ট্যান্ড-আপ কমেডির জগতে একটি বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়। পারফর্মারদের জন্য ফেসবুক এবং ইউটিউব কনটেন্ট শেয়ার করা, বিস্তৃত দর্শকের কাছে পৌঁছানো এবং লাইভ শোর বাইরেও নিজেদের উপস্থিতি তৈরি করার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে।

স্ট্যান্ড- আপ কমেডি

তিনি বলেন, 'ডিজিটাল মিডিয়া, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া, এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে। কমেডিয়ানরা রিল, শর্টস এবং ভিডিও অনলাইনে শেয়ার করার ফলে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি সম্পর্কে সচেতনতা এবং আগ্রহ চোখে পড়ার মতো বেড়েছে।'

এই ডিজিটাল বিপ্লবের কারণে শুধু কমেডির নাগালই বেড়ে যায়নি, দর্শকরাও বিনোদনের এই নতুন ধারা সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেছেন।

একই ভাব প্রকাশ করে দোহা বলেন, 'সত্যি বলতে, সোশ্যাল মিডিয়া কমেডিয়ানদের জন্য গেম-চেঞ্জার হিসেবে কাজ করেছে। নিয়মিত রিল আর ভিডিও লাখ লাখ ভিউ পায়, যা আমাদের ঢাকার বাইরেও বড় ফ্যানবেস তৈরি করতে সাহায্য করেছে। তার ওপর, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে স্ট্যান্ড-আপ স্পেশালগুলো বাংলাদেশি কমেডিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।'

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওপেন মাইকের আয়োজন বেড়ে যায়, এবং স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানরাও দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেন। এখন 'নাভিদস কমেডি ক্লাব (এনসিসি)' এবং 'স্ট্যান্ডআপ ঢাকা'র মতো সংগঠন রয়েছে, যারা নতুন প্রতিভাদের গড়ে তুলতে কাজ করছে। এই পারফর্মারদের যে জনপ্রিয়তা ও সমর্থন মিলেছে, তা খুব সহজেই এই নতুন ধারাকে আপন করে তুলেছে, যার ফলে শুধু ঢাকা নয়, অন্যান্য জেলাতেও নিয়মিত শো আয়োজন করা সহজ হয়ে উঠেছে।

স্ট্যান্ড-আপ কমেডির বিস্তার

বর্তমান বাংলাদেশের অনেক কিছুই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, বিনোদন মাধ্যমও এর ব্যতিক্রম নয়। এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোতে ছোট থেকে বড় নিয়মিত অনুষ্ঠান হতে দেখা যায়। প্রতি সপ্তাহেই শো অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং তা আমাদের মাতৃভাষায়, যা স্ট্যান্ড-আপ কমেডিকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। ঢাকা এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

স্ট্যান্ড- আপ কমেডি

সামি দোহা বলেন, 'নিরলস প্রচেষ্টার ফলে এখন শহরে একাধিক শো হচ্ছে, যা ভেন্যু এবং আয়োজকদের কারণেই সম্ভব হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'নিয়মিত এই অনুষ্ঠানগুলো আয়োজনের ফলে কমেডিয়ানরা নিজেদের একটি সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলেছে এবং দর্শকদের স্ট্যান্ড-আপ কমেডিকে একটি শিল্পরূপ হিসেবে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সহায়তা করেছে। এখন কমেডিয়ানরা এমন সব দৈনন্দিন বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করছেন, যেগুলোর সঙ্গে দর্শক সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারেন—যেমন ঢাকার ট্রাফিকের বিশৃঙ্খলা, পারিবারিক সম্পর্ক, কিংবা আমলাতান্ত্রিকতা ও রাজনীতির নানা হাস্যকর দিক। এসব বিষয় সাধারণত দর্শকের মাতৃভাষাতেই উপস্থাপন করা হয়, যা এর জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।'

সামি দোহা বলেন, 'আমি বলব বাংলাদেশি দর্শকদের জন্য কমেডি তৈরি করা যেমন একটি চ্যালেঞ্জ, তেমনি এক ধরনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।'

অন্যান্য দেশে যেমন বিতর্কিত বা সমালোচিত বিষয় নিয়ে রসিকতা হরহামেশাই হয়ে আসে, বাংলাদেশের ব্যাপারটা একটু আলাদা। এ দেশের স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানরা সাধারণত একটু ভদ্র এবং সংযত ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। তারা হাস্যরসের পাশাপাশি সামাজিক শালীনতার একটা সুন্দর ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেন।

২০২৪ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথমবারের মতো স্ট্যান্ডআপ কমেডি শো হওয়া ছিল এই ধারার শিল্পের জন্য একটা বড় অর্জন। এই শোতে মাহেদী হাসান তরু, আখলাক সিদ্দিকী এবং শাওন মজুমদারের মতো পরিচিত পারফর্মাররা অংশ নিয়েছিলেন।

এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলো এক একটা প্রমাণ, যে স্ট্যান্ডআপ কমেডি কেবল গণ্ডির মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই, বরং বাংলাদেশে এটি ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় একটি সাংস্কৃতিক ধারায় পরিণত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় 'রোস্ট অফ সালমান মুক্তাদির' নামের অনুষ্ঠানটির কথা, যেটি বন্যার্তদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। এই শোতেই দেখা গেছে, বাঙালি দর্শকদের বিতর্কিত কিংবা সাহসী কমেডিতে আপত্তি নেই, যদি তা সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করা হয়।

আজকের স্ট্যান্ড-আপ কমেডি দৃশ্যের আরেকটা দারুণ দিক হলো—কমেডিয়ানরা বিভিন্ন ধরনের স্টাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। কেউ কেউ জীবনে ঘটে যাওয়া সাধারণ কিন্তু হাস্যরসাত্মক ঘটনা নিয়ে কথা বলেন (যেটাকে বলা হয় অবজারভেশনাল হিউমার), আবার কেউ কেউ নিজেকে নিয়েই মজা করেন বা সমাজের ট্যাবু বিষয়গুলো নিয়ে হালকা-পাতলা ঠাট্টা করেন। কমেডির জগতে এমন বৈচিত্র্য প্রশংসার দাবি রাখে এবং এর সবচেয়ে ভালো দিক হলো—কমেডিয়ান আর দর্শকদের মধ্যে একটা দারুণ সখ্যতা তৈরি হয়, যেটা বাইরের দেশে প্রায়শই দেখা যায়।

স্ট্যান্ড-আপ কমেডি দিনকে দিন আরো বড় হচ্ছে এবং এই মাধ্যমটি কেবল বিনোদনের জন্যই নয়, বরং প্রিয় মানুষদের সাথে সময় কাটানোর জন্য চমৎকার একটা ইভেন্টে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের স্ট্যান্ডআপ কমেডির এই পরিবর্তন শুধু বিনোদনের জন্য নয়—এটা একটা সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি। মানুষ একসঙ্গে বসে আনন্দ ভাগ করে নিতে পারছে, ব্যস্ত জীবনে কিছুটা খুশির মুহূর্ত খুঁজে পাচ্ছে, এই বা কম কী?

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

ছবি কৃতজ্ঞতা: সাদাব শাহরোখ হাই

 

Comments

The Daily Star  | English

Why are onion prices rising abruptly?

Onion prices have been increasing over the past weeks, as farmers and traders release fewer stocks to local markets in the hope of better returns amid the government’s suspension of imports

1h ago