ভিডিও পডকাস্ট জনপ্রিয় হলো যেভাবে

ভিডিও পডকাস্ট

বাংলাদেশের ডিজিটাল কন্টেন্ট অঙ্গনে প্রবেশ করেই পডকাস্ট আমাদের তথ্য গ্রহণ এবং গল্প বলার ধরনে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। কোভিড মহামারির সময়ে কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা নানাভাবে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন, যার ফলে তৈরি হয়েছে ভিডিও পডকাস্ট নামক নতুন এক মাধ্যম যা জীবনধারা, ক্যারিয়ার পরামর্শ, মানসিক স্বাস্থ্য ও পপ কালচারের মতো বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে আলোচনা করার এক বাস্তবসম্মত ও আকর্ষণীয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। পডকাস্ট এখন আর কেবল প্রচলিত গণমাধ্যম বা ইউটিউবের মনোলগনির্ভর ভ্লগেই সীমাবদ্ধ নয়, পডকাস্ট এখন এক সত্যিকার, ভিজ্যুয়ালভাবে সমৃদ্ধ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে—যা ক্রিয়েটর ও দর্শক-শ্রোতাদের সমানভাবে আকর্ষণ করছে।

ভিডিও পডকাস্ট কবে শুরু হল, কী কারণে এর সৃষ্টি হল, আর কেন বা কীভাবে এটি আমাদের জীবনে এত গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে? টু সেন্টস পডকাস্টের নাফিস সেলিম, দ্য ব্লুপ্রিন্ট পডকাস্টের নীল নাফিস এবং স্কেন মিডিয়ার পথিকৃৎ সামির আহমেদের থেকে জানব বাংলাদেশে ভিডিও পডকাস্টের আদ্যোপান্ত।

পডকাস্টের মূল আকর্ষণঃ অকৃত্রিমতা

পডকাস্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হল এর স্বতস্ফুর্ততা। টিভি বা রেডিওর ঝকঝকে নিখুঁত কন্টেন্টের বিপরীতে, পডকাস্ট স্বতস্ফুর্ততাকে আপন করে নেয়।

বিষয়টি নাফিস সেলিম চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, 'পডকাস্টই নতুন রেডিও। অন্য সবকিছুর থেকে এটি আলাদা কারণ এর নিজস্ব একটি অকৃত্রিম দিক রয়েছে। টিভির মত পালিশ করা ও স্ক্রিপ্টেড সংলাপ নয়, পডকাস্টগুলো তুলনামূলক অকৃত্রিম ও খোলামেলা।'

ভিডিও পডকাস্ট

পডকাস্টের অকৃত্রিমতা নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করে, বিশেষত যারা একই ধরনের কন্টেন্ট দেখতে দেখতে ক্লান্ত।

স্ক্যানডেলাস নামক স্বনামধন্য পডকাস্ট সিরিজের সামির আহমেদ বলেন, 'আমাদের কনটেন্ট বাইরের চাকচিক্যে গুরুত্ব না দিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনাকে স্পর্শ করে, এমন অনেক বিষয় তুলে আনে। যেগুলো প্রচলিত গণমাধ্যম এড়িয়ে যায়।'

তিনি আরো বলেন, 'আমরা মানুষের গভীরে গিয়ে তাকে জানার চেষ্টা করি এবং দীর্ঘ কন্টেন্টের পাশাপাশি আমাদের ফিডে ছোট ছোট ক্লিপগুলোও রাখার চেষ্টা করি।'

তার কথার সঙ্গে নীল নাফিস একমত পোষণ করেন যে ছোটখাট খুঁত পডকাস্টের বৈশিষ্ট্য, এটি কোন ভুল নয়।

তিনি বলেন, 'এই খুঁতগুলোই পডকাস্টকে বিশেষ করে তোলে। যারা সত্যিকারের মূল্যবান কন্টেন্ট খোঁজেন, তাদেরকে পডকাস্টের এই অকৃত্রিম দিকটিই আকর্ষণ করে।'

পডকাস্টিং জগতের আকর্ষণই হলো এটি শ্রোতাদের সঙ্গে একান্ত, প্রায় ঘরোয়া এক সম্পর্ক গড়ে তোলে।

নাফিস সেলিম বলেন, 'আমাদের শ্রোতারা প্রায়ই বলেন যে 'টু সেন্টস পডকাস্ট' শুনলে মনে হয় ঘরের কথা শুনছি। আসলে পডকাস্টে বাস্তব, মিল পাওয়া যায় এমন এবং অনেক মানবিক ব্যাপারগুলো নিয়ে কাজ করা হয়।'

তবে এই সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়, পডকাস্ট এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যাতে কনটেন্টটি সরাসরি শ্রোতাদের জীবনের সঙ্গে কথা বলে।

নীল নাফিস তার কাজগুলোকে একপ্রকার পরোক্ষ পরামর্শ বা মেন্টরশিপের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখেন, 'আমি আমার পডকাস্টে মেন্টরদের নিয়ে আসি, যারা আমার জীবনকে একটু গুছিয়ে নিতে সাহায্য করেন। আমার দর্শকরাও নিজেদের আমার জায়গায় কল্পনা করে সেই পরামর্শগুলো নিজেদের জীবনের জন্য সাজিয়ে নেন।'

এই কৌশলটি বেশ কাজের, কন্টেন্ট উপভোগের পাশাপাশি নিজের জীবনেও এটি চমৎকারভাবে কাজে লাগানো যায়।

ভিডিও-ভিত্তিক পৃথিবীতে গল্প বলার কৌশল

ডিজিটাল কন্টেন্টে ভিডিওর দাপটের মাঝে শুধু-অডিও কনটেন্টের বিবর্তন ছিল সময়ের ব্যাপার। ইউটিউব, ফেসবুক বা টিকটকে স্ট্রিম হওয়া ভিডিও পডকাস্ট এখন বাংলাদেশের ভিজ্যুয়াল-ভিত্তিক শ্রোতাদের জন্য আদর্শ মাধ্যম।

পডকাস্ট

এই বিষয়ে সামীর আহমেদ বলেন, 'অস্ট্রেলিয়ায় বড় হওয়ার সময় আমি দেখেছি তারা কীভাবে প্রতিটি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম দখলে নিয়েছে। ঢাকা এসে বুঝলাম এখানকার ক্রিয়েটররা এখনো ফেসবুক লাইভে আটকে আছেন, যেগুলোকে তারা অনায়াসে পডকাস্ট বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। স্কেন মিডিয়াতে পরিকল্পিত এক কনটেন্ট ডিস্ট্রিবিউশন স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে আমরা তাদেরকে সাধারণ সেটআপ থেকে স্টুডিওতে নিয়ে গিয়েছি।'

এই পরিবর্তন কাজে দিয়েছে, যার ফলে ২ সেন্টসের মতো কিছু প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ন ভিউ অর্জন করেছে।

নীল নাফিস ভিডিওর স্কেলেবিলিটি নিয়ে বলেন, 'এক ঘণ্টার একটি এপিসোড থেকে অনেকগুলো ছোট ছোট ক্লিপ বা রিল বানানো যায়, ফলে রিচ বেড়ে যায়। ভিজ্যুয়াল উপাদানগুলো আরও বেশি এনগেজিং, যা দর্শকদের সঙ্গে গভীরভাবে সংযোগ তৈরির সুযোগ তৈরি করে দেয়।'

গ্লোবাল ট্রেন্ডের সঙ্গে বন্ধন

বাংলাদেশি নির্মাতারা যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন, তা তাদের দর্শক-শ্রোতাদের মতোই বৈচিত্র্যময়। উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা ও ব্যক্তিগত উন্নয়ন থেকে শুরু করে সংস্কৃতি ও সামাজিক গল্প, সবকিছু নিয়েই কাজ হয়। প্রতিটি পর্বে উঠে আসে মেধা পাচার রোধ থেকে শুরু করে তরুণ পেশাজীবীদের জন্য ফ্রিল্যান্স কৌশল—সবকিছুই।

নীল নাফিসের সঙ্গে করা একটি পর্বের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে নাফিস সেলিম বলেন, 'শ্রোতারা জানিয়েছেন, এটি তাদের নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে ও দায়িত্ব নিতে অনুপ্রাণিত করেছে। এটাই পডকাস্টের আসল শক্তি—আলাপচারিতার মাধ্যমে বাস্তব জীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসা।'

কনটেন্ট নির্মাতা ও উদ্যোক্তা রাফায়াত রাকিব সম্প্রতি শুরু করেছেন তার নিজের শো। কেন শুরু করলেন—জানতে চাইলে এই কর্মপ্রাণ তরুণ জানান, তিনি বিশ্বাস করেন তার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বাংলাদেশের তরুণদের নিজেদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিতে উদ্বুদ্ধ করা যায়।

তিনি আরো বলেন, 'বাংলাদেশের দরকার একজন শীর্ষস্থানীয় পেশাদার ও সার্টিফাইড মানুষের দিকনির্দেশনা। এতসব ভুয়া সফল ফ্রিল্যান্সারের ভিড়ে একজন বাস্তব সাফল্যের প্রমাণ থাকা মানুষকেই দেশের তরুণদের অনুপ্রাণিত করার জন্য কথা বলা উচিত, তাদের যোগ্যতা যাই হোক না কেন।'

অন্যদিকে রাফায়াতের মতে, যারা গতানুগতিক ধারার বাইরে ছিটকে পড়েছে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এটি বেশ ভালো একটি মাধ্যম।

তিনি বলেন, 'সবাই আরেকটি সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখে। আমি চাই কর্পোরেট দুনিয়া, সমাজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া মানুষরা সামনে এগিয়ে আসুক, যেন বাংলাদেশ ২.০-তে আমাদের মতো আরও অনেকের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। কারণ আমরা যদি উদ্যোগ না নিই, তাহলে কে নেবে?'

সামির আহমেদের স্ক্যানড্যালাস পডকাস্টের মূল লক্ষ্য হলো অতিথিদের গভীরভাবে জানা। শুধু তাদের সফলতা নিয়ে কথা না বলে তাদের ব্যর্থতা, সংকট এবং নিজেদের তৈরি করার গল্প শোনা।

তিনি বলেন, 'এই শো শুধুতাদের বড় অর্জনের কথা বলে না, তাদের জীবনের কান্না, হতাশা, সংকটকাল এবং সেই জায়গা থেকে নিজেকে উন্নত করার মানসিকতা নিয়ে কথা বলে।'

সংকট অতিক্রম করা

এই ধারাটি বেশ আশা জাগানিয়া হলেও যাত্রাটি খুব সহজ নয়। এক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হলো খরচ। একটি স্টুডিও গড়ে তোলা, মানসম্পন্ন অডিও-ভিজ্যুয়াল সেটআপ নিশ্চিত করা এবং ভালো কনটেন্ট তৈরি করার জন্য উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের প্রয়োজন। সামীর আহমেদ উল্লেখ করেন, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, কিছু কনটেন্ট ক্রিয়েটর এখনও উন্নত প্রোডাকশনে বিনিয়োগ করতে অনাগ্রহী।

এছাড়াও ব্যক্তিগত আগ্রহ আর দর্শকদের প্রত্যাশার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাও এক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

নীল নাফিস বলেন, 'আমি শুধু সেই জিনিসগুলোই তৈরি করি, যেগুলো নিয়ে আমি নিজে আগ্রহী। এর মাধ্যমে এমন একটি অডিয়েন্স তৈরি হয়, যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে আগ্রহী। শুধু তাদেরকে খুশি করাই মূল লক্ষ্য নয়, বরং তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করাই গুরুত্বপূর্ণ।'

বিভিন্ন মতামতের ভিড়ে নিজস্বতা বজায় রাখা দড়ির ওপর হাঁটার মতো একটা ব্যাপার।

নাফিস সেলিম বলেন, 'এখনো এমন কোন অতিথি আসেননি, যার সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করি। তবে ভবিষ্যতে যদি তা করতে হয়, আমাদের লক্ষ্য হবে আলাপ, তর্ক নয়। কারণ সব জায়গা থেকেই শেখার সুযোগ থাকে।'

সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পথে

বর্তমানে ভিডিও পডকাস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে প্রচলিত মিডিয়ার ঝলমলে দিকের চেয়ে সত্যবাদিতা, গভীরতা ও সংযোগ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। এটি একটি ক্ষণস্থায়ী ট্রেন্ড নয় বরং শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, যা শ্রোতাদের বিভিন্ন আলোচনা শুনতে আগ্রহী করে তুলেছে।

ভিডিও পডকাস্ট ইতোমধ্যেই মানুষের চিন্তায় প্রভাব ফেলছে।

নীল নাফিস বলেন, তার বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যাপারটি নিয়ে এক এপিসোডে আলোচনা করার পর মানুষ আবার ব্রেইন ড্রেইন বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে এবং কীভাবে দেশে নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।

সামির আহমেদ বলেন, সোশাল মিডিয়াতে অনেক ধরনের কন্টেন্ট আছে যা অল্প সময়ের জন্য মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হলেও খুব একটা ফলপ্রসূ নয়, তবে পডকাস্টের গভীর আলোচনা মানুষকে ভাবতে সাহায্য করে। আমরা যত বেশি এ ধরনের আলোচনা শুনব, আমাদের চিন্তাভাবনায় এর প্রভাব পড়বে, আমাদের বিভিন্ন ভাবে ভাবতে সাহায্য করবে।

নীল নাফিস ভিডিও পডকাস্টকে ব্যক্তিগত উন্নয়নের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখেন এবং বলেন, 'আমি প্রতিটি পর্বে কিছু না কিছু শিখি। মনে হয় যেন প্রত্যেক অতিথির সঙ্গে একেকটা মাস্টারক্লাসের সামনের সারিতে বসে আছি।'

এই প্রভাব পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। স্কেন মিডিয়ার মতো প্ল্যাটফর্ম ২৫টির বেশি ক্লায়েন্টের জন্য ইতোমধ্যে ২০০টির বেশি পর্ব তৈরি করেছে, যা মিলিয়ে এক বিলিয়নেরও বেশি ভিউ অর্জন করেছে। শুধু নাফিস সেলিমের '২ সেন্টস পডকাস্ট' দুই বছরের মধ্যে ২০ হাজার সাবস্ক্রাইবার থেকে বেড়ে প্রায় পাঁচ লাখে পৌঁছে গেছে, যা এই ধারার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার প্রমাণ।

সামির আহমেদ, নীল নাফিস ও নাফিস সেলিমের নেতৃত্বে, প্রমাণিত হচ্ছে যে সঠিক কৌশল, উৎসাহ ও আন্তরিকতা থাকলে সম্ভাবনা সীমাহীন। এমন এক দেশ, যেখানে প্রতিটি শব্দের গভীর অর্থ রয়েছে, সেখানে ভিডিওগুলো এমন সব ভাবনার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছে যা শোনা প্রয়োজন, এবং তা শুধু স্ক্রিনে নয় অনেক দূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments

The Daily Star  | English

4 hurt in RU clashes

The confrontations took place in four separate incidents, spanning from last night and today

5h ago