সঞ্চালন লাইনের কাজের ধীরগতিতে বারবার পেছাচ্ছে রূপপুর প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদন

স্টার ফাইল ফটো

নদী দিয়ে গ্রিড লাইন পারাপারের কাজ শেষ না হওয়ায় পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে নির্মিত দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন শুরু হতে আরও দেরি হওয়ার আশঙ্কাতৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক পারমানবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সদস্যরা পদ্মা নদীর পাড়ের এই প্রকল্প এলাকায় কাজের আগ্রগতি পরিদর্শনে আসেন। তাদের সঙ্গে আলোচনায়ও গ্রিড লাইন কাজের বিলম্বের বিষয়টি বারবার উঠে আসে।

প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শন শেষে আইএইএ প্রতিনিধি দল ২৪ ক্যাটাগরিতে ভালোভাবে কাজ সম্পন্ন করার জন্য সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও সুনির্দিষ্ট ১৭টি বিষয়ে আরও উন্নতি করার সুপারিশ এসেছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

প্রকল্পের উৎপাদন শুরু করতে যেসব প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে অসম্পন্ন গ্রিড লাইনের কাজের বিষয়টি উঠে এসেছে। 

আইএইএর ১৭টি পরামর্শের মধ্যে অন্যতম হলো—প্রকল্পের অভ্যন্তরীণ অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রকল্প এলাকায় পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করাসহ প্রকল্পের কাজের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক। 

আইএইএর প্রতিনিধিদলের পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের উৎপাদন শুরুর আগে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে বলে মনেকরছেন প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। 

'আইএইএর নির্দেশনা মেনে রূপপুর প্রকল্পের প্রতিটি কাজের অগ্রগতি হচ্ছে,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প কর্মকর্তা ড. জাহিদুল হাসান। 

প্রকল্পের উৎপাদন শুরু করার আগে আইএইএর নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ দল প্রকল্পের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার পরেই উৎপাদন শুরুর দিকে যেতে পারবে দেশের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল এ বিদ্যুৎ প্রকল্পটি। এ লক্ষ্যে আইএইএর প্রতিটি নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করেই কাজের অগ্রগতি হচ্ছে বলে জানান প্রকল্প কর্মকর্তা। 

সম্প্রতি মার্চে আইএইএর প্রতিনিধি দল প্রকল্প পরিদর্শনের পরে ২৪টি দিক তুলে ধরেছে, যা প্রকল্পের এ পর্যায়ে একটি বড় অর্জন বলে মনে করেন প্রকল্প কর্মকর্তা ড. জাহিদুল। 

তিনি বলেন, 'প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ ৯৪ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রথম ইউনিটের উৎপাদন শুরু করার জন্য পদ্মা নদীর উপর নির্মিতব্য গ্রিড লাইনের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে উৎপাদনে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হবে।' 

সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হওয়ার পরে উৎপাদনে যেতে ৩-৪ মাস পর্যন্ত সময় লাগবে বলে জানান তিনি। 

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর প্রকল্পের জন্য ১৬ কিলোমিটার নদী পারাপার লাইনসহ ৬৬৯ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর মধ্যে, পদ্মা নদীর উপর ২ কিলোমিটার নদী পারাপার লাইন প্রথম ইউনিটের উৎপাদন শুরুর আগেই শেষ করতে হবে।

যমুনা নদীর উপর ১৪ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন শুরুর আগে প্রয়োজন হবে বলে জানান প্রকল্প কর্মকর্তারা। 

পদ্মা নদীর উপর সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় রূপপুর প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের উৎপাদন শুরুর আগে প্রয়োজনীয় অনেক পরীক্ষা এখনো শুরু করা যায়নি বলে জানান তারা। 

সরেজমিনে পদ্মা নদীর পাকশি ও ভেড়ামারা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদী পার করার সঞ্চালন লাইনের টাওয়ার নির্মাণ কাজ শেষ দিকে। এখন নদীর মাঝের টাওয়ার নির্মাণের কাজ চলমান। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সঞ্চালন লাইনের নদী পারাপার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. দেলওয়ার হোসেন বলেন, 'ইতোমধ্যে পদ্মা নদীর উপর সঞ্চালন লাইনের কাজের ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আশা করা হচ্ছে মে মাসের মধ্যে এই সঞ্চালন লাইনের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে।' 

পিজিসিবির এই কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে রূপপুর-বগুড়া ৪০০ কেভি সিঙ্গেল সার্কিট লাইন ও রূপপুর বাঘাবাড়ি ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন সচল রয়েছে। এ লাইনগুলো দিয়ে ৪ হাজার মেগওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব। 
ফলে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি পরীক্ষার জন্য এসব লাইন দিয়ে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে বলে জানান তিনি। 

রূপপুর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. জাহিদুল হাসান বলেন, 'পারমাণবিক প্রকল্প অন্য সব প্রকল্পের মতো নয়। এখানে প্রতিটি কাজ শতভাগ নিশ্চিত করেই পরবর্তী ধাপে যাওয়া হয়।' 

প্রকল্পের মুল ডিজাইনের বাইরে কোনো কাজ গ্রহণযোগ্য হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। ফলে নিশ্চিতভাবেই পদ্মার উপর লাইন নির্মাণের কাজ শেষ করার পরেই প্রকল্পের উৎপাদন শুরুর প্রস্তুতির জন্য পরবর্তী ধাপে যেতে হবে।
তবে প্রকল্প সুত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে প্রকল্পের চলমান লাইন দিয়ে প্রথম ইউনিটের প্রাইমারি সার্কিটের ২৪ দশমিক ৫ মেগাপিক্সেল প্রেসার দিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। 

রূপপুর প্রকল্পের উৎপাদন শুরুর আগে অনেকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রকল্পের মুল উৎপাদনে যাওয়ার প্রস্তুতি চালাতে হবে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। 

এদিকে নানা জটিলতায় কয়েক দফায় সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজ পিছিয়েছে। স্থল পথে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের চেয়ে নদী পথে সঞ্চালন লাইনের কাজ অনেক কঠিন। 

সার্বিকভাবে সঞ্চালন লাইনের কাজ পেছানোর কারণে উৎপাদন বিলম্বিত হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের নির্মাণ কাজ করছে রাশিয়া। প্রকল্পের ৯০ শতাংশ অর্থ ঋণ হিসেবে দিয়েছে রাশিয়া। 

রাশিয়ার ভিভিইআর ১২০০ মেগওয়াট মডেলের দুটি চুল্লি রূপপুর প্রকল্পে বসানো হয়েছে। প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজ ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর শুরু হয় এবং দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই শুরু হয়। 

প্রকল্পের শিডিউল অনুযায়ী প্রথম ইউনিটের উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর আর দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর। 

কিন্তু নান জটিলতায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ ২ বছর বাড়ানো হয়েছে। এতে ২০২৪ সালের শেষের দিকে প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সঞ্চালন লাইনের কাজ পিছিয়ে থাকায় নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন শুরু করা যায়নি। 

প্রকল্প পরিচালক বলেন, 'সব ঠিক থাকলে এ বছরের শেষ দিকে প্রথম ইউনিটের উৎপাদন শুরু করা যাবে। এ সময় আইএইএর সেফটি রিভিউ টিম উৎপাদন পূর্ব পর্যবেক্ষণে এসে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পরেই উৎপাদনে যাওয়া যাবে।' 

'তবে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হওয়ার পরেই উৎপাদনে যাওয়ার পরবর্তী সময় নিশ্চিত করে বলা যাবে,' যোগ করেন তিনি।

তবে সঞ্চালন লাইন ছাড়াও উৎপাদনের আগে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধাপ আছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রূপপুর প্রকল্পের উৎপাদন শুরুর আগে প্রয়োজনীয় সব নিরাপত্তা পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়া প্রকল্পের মুল ব্যয় নির্ধারণ করে বিদ্যুতের মুল্য নির্ধারণ করে পাওয়ার পারচেজ (বিদ্যুৎ ক্রয়) চুক্তি করতে হবে, দক্ষ প্রকল্প কর্মী নিয়োগ করতে হবে, ইমারজেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস ও রেসপন্স সেন্টার নির্মাণ করাসহ নিরাপত্তার সকল স্তর নিশ্চিত করেই রূপপুর প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Pathways to the downfall of a regime

The erosion in the credibility of the Sheikh Hasina regime did not begin in July 2024.

7h ago