ইসলামি ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ কি কার্যকর সমাধান?

বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের পরিচালনায় থাকা কয়েকটি ব্যাংকের সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও দেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সরকার বিদ্যমান সব ইসলামি ব্যাংক একীভূত করে দুটি ইসলামি ব্যাংক গঠন করতে পারে।
বিদ্যমান অধিকাংশ ইসলামি ব্যাংক বর্তমানে সংকটে থাকায় দেশের ইসলামি ব্যাংকিং খাতকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স-২০২৫ অনুমোদন করেছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো এই অধ্যাদেশের আওতায় অবসায়ন বা মার্জার হতে পারে।
দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এমনকি প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের তুলনায় বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তবে এস আলম গ্রুপ একের পর এক বেশ কয়েকটি ইসলামি ব্যাংকের পরিচালনার দায়িত্ব নিলে এই খাত সংকটে পড়ে।
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তার কারণে বিগত কয়েক বছরে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকিং থেকে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। অনেক প্রচলিত ব্যাংক এখন ইসলামি ব্যাংকে রূপান্তরিত হতে আগ্রহী। যদিও সেসব ব্যাংক ডেডিকেটেড শাখা বা উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিয়ে আসছে।
বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক আছে। সেগুলো হলো—ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
গত বছর শেষে এই ১০ ব্যাংকের মোট আমানত ছিল তিন লাখ ৮৫ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ চার লাখ ৮৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছয় পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলমের পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত এই ছয় ব্যাংকের কয়েকটি সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সংকট কেটে যাচ্ছে।
ইসলামি ব্যাংকিং খাতে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো এবং আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের অবস্থাও তেমন খারাপ নয়।
অন্তত তিনটি ইসলামী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, ১০ ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করে দুটি বড় ব্যাংক গঠন বাস্তবসম্মত বলে বিবেচিত হবে না।
তাদের ভাষ্য, আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় দুই বা তিনটি ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করা যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মন্তব্য আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বলেও মনে করেন তারা।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর চেয়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনা ও আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।'
তার মতে, 'সুশাসন নিশ্চিত না করে যদি ব্যাংকের সংখ্যা কমানো হয় তাহলে ভালো ফল আসবে না।'
মুস্তাফা কে মুজেরি আরও বলেন, 'ব্যাংকিং খাতের সমস্যা দূর করে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তবে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান উন্নতি দেখা যায়নি।'
তিনি মনে করেন, ইসলামি ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সুশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকার বিদ্যমান ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দুটি বড় ইসলামি ব্যাংক করলে সমস্যার সমাধান হবে না।
'দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর পরিবর্তে সেগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। শুধু সংখ্যা কমানোই সমাধান নয়।'
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন মনে করেন, দুর্বল ইসলামি ব্যাংকগুলোকে আগে শক্তিশালী করতে হবে। অন্যথায়, এটি ইতিবাচক ফল দেবে না।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন এ ধরনের ব্যাংকগুলোকে বাঁচতে হবে। তাহলে সরকার ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্সের আওতায় তাদের একীভূত করতে পারবে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কার এজেন্ডার অংশ হিসেবে বেশিরভাগ ইসলামি ব্যাংক এখন বৈশ্বিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদমানের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পর্যালোচনার পর কয়েকটি ব্যাংক একীভূত হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
Comments