র‌্যাবের জবাবদিহি নিশ্চিতে তৈরি হয়েছে আইনের খসড়া

জবাবদিহি নিশ্চিত করতে র‌্যাব আইন-২০২৪-এর একটি খসড়া প্রণয়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালক একেএম শহীদুর রহমান।

পুলিশ সপ্তাহের অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার এক সেমিনারে তিনি বলেন, 'এই আইন কার্যকর থাকলে কেউ আর ব্যক্তিগত স্বার্থে বলপ্রয়োগ করতে পারবে না।'

দীর্ঘদিন ধরেই র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। ২০২১ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব ও সংস্থাটির ছয়জন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

আড়াই মাস আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর জুলাইয় গণঅভ্যুত্থান নিয়ে একটি তথ্য-অনুসন্ধান প্রতিবেদনে র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করে।

গতকাল সেমিনারে র‌্যাব মহাপরিচালক শহীদুর রহমান তার উপস্থাপনায় মূলত র‌্যাবের সংস্কার ও সাফল্যের দিকগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, র‌্যাব এখন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে র‌্যাব সম্প্রতি তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্ত সেলকে আরও জোরদার করেছে বলে তিনি জানান। পাশাপাশি, সবপর্যায়ে স্বচ্ছতা আনার জন্য একটি মানবাধিকার সেলও গঠন করা হয়েছে।

তার ভাষ্য, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে র‌্যাব ৪৪২টি হত্যা মামলার সঙ্গে জড়িত এক হাজার ৪৮৭ জন এবং নাশকতা-সংক্রান্ত মামলায় আরও ১৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

পুলিশ সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং ট্যুরিস্ট পুলিশসহ আরও কয়েকটি পুলিশ ইউনিট পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমসহ শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে নিজেদের উপস্থাপনা তুলে ধরেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, প্রায় সব ইউনিটই মৌলিক পরিচালন ব্যয়ের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেছে।

ইউনিটগুলো জানায়, পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ না থাকায় অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ব্যক্তিগত অর্থ ব্যয় করে তদন্ত পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া, অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধার থেকে শুরু করে এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলাদা কোনো তহবিল না থাকা দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশের জন্য হতাশার কারণ।

জনবল ও তহবিলের অভাব

গতকাল সন্ধ্যায় সরকারের উপদেষ্টা ও সচিবদের সঙ্গে এক অধিবেশনে সাতজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা তাদের সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ নাজমুল করিম খান চরম জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, জিএমপিতে বর্তমানে এক হাজার ১৬৯ জন কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের প্রত্যেককে গড়ে ২৮৮ জন নাগরিকের সেবা দিতে হয়। তিনি ইউনিটে আরও দুই হাজার ৪২৮ জন জনবল বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন।

ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি আতাউল কবির রিজার্ভ ফোর্স না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে দ্রুত এ বিষয়টি সমাধানের প্রস্তাব দেন।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি রোমানা আক্তার অপরাধ তদন্ত কার্যক্রম জোরদারে প্রতিটি বিভাগে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের সুপারিশ করেন।

হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি এএফএম আখতারুজ্জামান বসুনিয়া তার ইউনিটে আরও ছয় হাজার কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব দেন।

শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আনোয়ার হোসেন শিল্প এলাকায় পুলিশের কার্যকারিতা বাড়াতে কিছু শ্রম আইন সংশোধনের আহ্বান জানান।

ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান সময়মতো তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অধিক তহবিলের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

চট্টগ্রামের এসপি সাইফুল ইসলাম শান্ত কর্মকর্তাদের মনোবল ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভ্রমণ ও ওভারটাইম ভাতা চালুর প্রস্তাব দেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের হাউজিং অধিদপ্তরের এআইজি মোস্তাফিজুর রহমান পুলিশের আবাসন ব্যবস্থার জন্য গণপূর্ত বিভাগের অবকাঠামো বরাদ্দের দাবি জানান।

বৈঠকে উপস্থিত উপদেষ্টারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়নে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

তারা পুলিশ বাহিনীর কার্যকারিতা এবং জনমুখী সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ও সার্বিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, পুলিশের মর্যাদা ও সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রয়োজনীয় সংস্কার গ্রহণ করা হবে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে, যদিও আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান পুলিশ বাহিনীকে 'জনগণের বাহিনী' হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'পুলিশকে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা ত্যাগ করে জনগণের আরও কাছাকাছি থাকতে হবে।'

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ডিজিটাল রূপান্তরের কোনো বিকল্প নেই। প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রমের মাধ্যমে পুলিশের জনসেবামূলক ভূমিকা আরও কার্যকর করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইসিটি বিভাগ থেকে পূর্ণ সহায়তার আশ্বাসও দেন।

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি, আইন সচিব শেখ আবু তাহের, গণপূর্ত সচিব মো. নজরুল ইসলাম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব শিশ হায়দার চৌধুরী এবং অর্থ সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার।

দিনের কার্যক্রম শুরু হয় সিআইডির উপস্থাপনার মাধ্যমে।

সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি গাজী জসিম জানুয়ারি ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত সিআইডির পারফরম্যান্স তুলে ধরেন।

তিনি জানান, গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাবেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পদ খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে এই কমিটি এক হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদের সন্ধান পেয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আনুমানিক পাঁচ হাজার ৮০০ শতক জমি।

জসিম জানান, এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, নাবিল, ইউনিক ও সিকদারসহ বেশ কয়েকটি বড় ব্যবসায়িক গ্রুপ বর্তমানে তদন্তের আওতায় রয়েছে।

Comments