কান চলচ্চিত্র উৎসবে নোয়াখালীর আল আমিনের জয়গান

ছবি: আল আমিনের সৌজন্যে

কেউ কি কখনো কল্পনা করতে পেরেছিল, নোয়াখালীর শহরতলির সরু, আঁকাবাঁকা গলিপথ পেরিয়ে কোনো ছেলে একদিন কান চলচ্চিত্র উৎসবে পৌঁছাবে? অবশ্যই না। আল আমিন নিজেও কখনোই তা ভাবেননি। কিন্তু আজ তাই বাস্তব। আদনান আল রাজীব পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'আলি' ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ স্বীকৃতি (স্পেশাল মেনশন) পেয়েছে—এই মর্যাদাপূর্ণ আসরে যা এক অনন্যসাধারণ অর্জন।

শনিবার থেকেই 'আলি' সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে—বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে ইতিহাস গড়ে এটি প্রশংসিত হচ্ছে। নামচরিত্রে গভীর আবেগপূর্ণ অভিনয়ের মাধ্যমে আল আমিন দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেছেন, আর এখনো তিনি এই অভাবনীয় সাফল্যের ব্যাপারটি পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না।

'আমি কখনো ভাবিইনি যে অভিনয় করব। আর কান উৎসবে যাওয়ার সুযোগ তো এখনো স্বপ্নের মতোই লাগছে', বলছিলেন আল আমিন।

এই যাত্রা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু হয়েছে, একেবারেই পরিকল্পনাহীন—বললেন তিনি। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বশিরহাট এলাকার ছেলে আল আমিন বর্তমানে সরকারি মুজিব কলেজের বিএসএস (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

কান থেকে ট্রেনে প্যারিসে ফেরার পথে আল আমিন ভাবছিলেন সেই অসাধারণ যাত্রাপথের কথা, যা তাকে বাংলাদেশের এক নির্জন প্রান্তিক গ্রামীণ অঞ্চল থেকে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাসম্পন্ন চলচ্চিত্র উৎসবের জৌলুশ ও গৌরবময় মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছে।

'আলির চরিত্রের জন্য পরিচালক আদনান আল রাজীব খুঁজছিলেন নির্দিষ্ট এক ধরনের অবয়ব—একটি নিরীহ মুখ, লম্বা চুল, আর ডাগর চোখ, যা কোনো শব্দ ছাড়াই অনেক কিছু বলে দিতে পারে। এই চরিত্রের জন্য প্রায় ৪০ জনের অডিশন নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আসলে একজন অভিনয়শিল্পী খুঁজছিলেন না। তারা এমন কাউকে চাচ্ছিলেন, যে স্বাভাবিকভাবেই "আলি" হয়ে উঠতে পারে। আর সেটাই তারা আমার মধ্যে দেখেছেন,' জানান আল আমিন।

তাহলে এমন এক নতুন মুখ, যার কোনো মিডিয়া ব্যাকগ্রাউন্ড নেই—তাকে খুঁজে পেলেন কীভাবে?

আল আমিন বলেন, 'আসলে, আমি কয়েকটি মিউজিক রিয়েলিটি শোতে অডিশন দিয়েছিলাম। দ্বৈত কণ্ঠে গান গাইতে পারি বলে কিছুটা নজর কেড়েছিলাম, যদিও আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না। প্রাথমিক রাউন্ডগুলো পেরিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদ পড়ি। কারণ অন্যরা অনেক বেশি পরিণত ও দক্ষ ছিল।'

'সেই রিয়েলিটি শোগুলোর জন্য দেওয়া এমন এক সাক্ষাৎকার থেকেই "আলি" টিমের চোখে পড়ি আমি। শুরুতে ভেবেছিলাম তারা আমাকে ইউটিউবের কোনো ফিকশনের জন্য ডাকছে। তবে এই ধরনের কাজ করতে আগ্রহী ছিলাম না। ভেবে রেখেছিলাম না করে দেবো। কিন্তু মনে হলো, অন্তত জেনে নেওয়া যাক পরিচালক কে। যখন শুনলাম আদনান আল রাজীব, আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফোন করে জানালাম, আমি ঢাকায় অডিশন দিতে আসব।'

স্মৃতিচারণ করে আল আমিন বলেন, 'গত শুক্রবার আমরা "আলি"র স্ক্রিনিং দেখলাম ক্লদ ডেবুসি থিয়েটারে, ফেস্টিভাল প্যালেসের পাশে। ছবি শেষে পুরো অডিটোরিয়াম দাঁড়িয়ে টানা ১০ মিনিট তালি দিয়েছে। এটা ছিল একেবারেই অভাবনীয়—আজীবন মনে থাকবে। নিজে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না যে "আলি" মানুষকে এতটা নাড়া দিতে পারে। পরে অনেকেই এসে আমার সঙ্গে সেলফি তুললেন, বললেন কতটা ভালো লেগেছে তাদের ছবিটা।'

'আলি' চলচ্চিত্রটি গড়ে উঠেছে এক উপকূলীয় শহরকে কেন্দ্র করে, যেখানে গান গাওয়া নিষিদ্ধ। এক কিশোর ছেলেকে দেখা যায়—স্বপ্নপূরণের আশায় সে গোপনে একটি সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং শহরে চলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। কিন্তু এই নিষ্পাপ স্বপ্নের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ রহস্য।

পরিচালকের কথা বলতে গিয়ে আল আমিন বললেন, 'আদনান ভাই শুধু একজন প্রতিভাবান পরিচালক নন, তিনি ভালো মনের মানুষ হওয়ায় আমি ভাগ্যবান। তিনি কখনো সমালোচনা করেন না। আমি কিছু ভুল করলেও তিনি বলতেন, "তুমি ভালো করেছো, তবে আমার মনে হয় তুমি আরও ভালো করতে পারো"। এমন সমর্থন আমাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।'

যদিও 'আলি' ছিল তার অভিনয়ের হাতেখড়ি, আল আমিন বিশ্বাস করেন এখানেই শেষ নয়। 'এই ছবি আমাকে এমন সাহস দিয়েছে যা আমি আগে কখনো অনুভব করিনি। এখন আমি সত্যই বিশ্বাস করি, এই পথ ধরে আরও কিছু গড়ে তুলতে পারব।'

২৩ বছর বয়সী আল আমিন তার পরিবারের সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ। 'আমার মা-বাবা সবসময় আমার পাশে থেকেছেন। আমার গ্রামের অনেকেই হয়তো জানে না কান কী, কিন্তু তারা জানে আমি ফ্রান্স গিয়েছি, আর এটুকুই তাদের জন্য গর্বের বিষয়।'

শুরুতে সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে না পারায় কিছুটা নার্ভাস ছিলেন আল আমিন। 'কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারলাম, ভাষা কোনো বাধা নয়। স্ক্রিনিংয়ে ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপানের মানুষরা এসে বলেছিল, "তোমার গল্প আমাদের ছুঁয়ে গেছে"। এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা পুরস্কার।'

দেশে ফিরে আসার পর আল আমিন একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন। 'এটি আমাদের ভাষায় হবে, আমাদের মাটি আর মানুষের গল্প বলবে। আমি চাই আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েরা নিজেদের পর্দায় দেখতে পাবে, শুনতে পাবে নিজেদের গল্প।'

২০২৫ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে "শর্ট ফিল্ম পাম ডি'অর" পুরস্কার দেওয়া হয় 'আই অ্যাম গ্লাড ইউ আর ডেড নাউ' চলচ্চিত্রের জন্য, যার পরিচালক তাওফিক বারহোম নিজেও আল আমিনের অভিনয় প্রশংসা করেছিলেন। 'তিনি আমার কাছে এসে বলেছিলেন যে, আমার কাজটা তার খুব ভালো লেগেছে—আমি তখন একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ছিল এক স্বপ্নের মতো অনুভূতি,' বলেন আল আমিন।

অনুবাদ করেছেন মাহমুদ নেওয়াজ জয়

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

4h ago