ধনীদের জন্য কর বাড়ল, ৫ বছর পর ফিরল ৩০ শতাংশ হার

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকার আগামী অর্থবছরে সর্বোচ্চ আয়করের হার ৩০ শতাংশ করতে পারে। পাঁচ বছর পর এই উদ্যোগ আবার নেওয়া হচ্ছে।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বৈষম্য পরিমাপের পদ্ধতি গিনি সহগ ২০১৬ সালে শূন্য দশমিক ৪৮ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৯৯ হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরেই আগামী দুইবছরের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তবে নানামুখী চাপে তৎকালীন সরকার বাতিল করতে বাধ্য হন। যদিও সরকার বলেছিল—এই উদ্যোগ 'করের বোঝা কমাবে'। সংশোধিত অর্থ আইন অনুসারে, বিভিন্ন অংশীদারদের চাপে চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ উপার্জনকারীদের জন্য কর হার বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হয়েছিল।
আগাম ঘোষণা অনুযায়ী এখন সেই ব্যবস্থা ফিরে আসছে। অর্থাৎ সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার বেশি বার্ষিক আয়ের ওপর সর্বোচ্চ কর প্রযোজ্য হবে।
২০২০-২১ অর্থবছর থেকে পাঁচ বছর পর এই উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। সেসময় সরকার করোনা মহামারির পরে জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দিতে এই হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছিল।
এরপর থেকে ব্যক্তিগত আয়করের (পিআইটি) হারও অপরিবর্তিত আছে।
আসছে ২ জুন আগামী অর্থবছরের বাজেট পেশ করার সময় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ করের এই হার ঘোষণা দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমানে রাজস্ব বোর্ড পাঁচ বিভাগে আলাদাভাবে আয়কর আদায় করে।
সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর পাঁচ শতাংশ, সাড়ে আট লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, সাড়ে ১৩ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, সাড়ে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ২০ শতাংশ ও সাড়ে ১৮ লাখ টাকার বেশি আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ কর আদায় করা হয়।
করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ ছাড়া অন্যান্য হারও পুনঃনির্ধারণ করা হতে পারে।
ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার টাকা; নতুন করদাতারা দেন এক হাজার টাকা।
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যক্তির অবস্থান নির্বিশেষে ন্যূনতম আয়কর পাঁচ হাজার টাকা করতে পারে। এর অর্থ হলো—সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও গ্রামে বসবাসকারীদের একই হারে ন্যূনতম কর দিতে হবে।
বর্তমানে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার টাকা; অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় চার হাজার টাকা এবং সিটি করপোরেশনের বাইরে পৌর ও গ্রামাঞ্চলে তিন হাজার টাকা।
সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে অঞ্চলভিত্তিক ন্যূনতম করের হার সংশোধন করা হয়।
এ ছাড়াও, নতুন করদাতা অর্থাৎ যারা প্রথমবার তালিকাভুক্ত হবেন তাদের প্রথম বছরে ন্যূনতম কর দিতে হবে এক হাজার টাকা।
এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া মনে করেন, করমুক্ত আয়সীমা অন্তত সাড়ে চার লাখ টাকা করা উচিত।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এতে প্রান্তিক করদাতাদের বোঝা কমবে। জনগণ কর দিয়ে অবদান রাখতে চায়। যেমন, ভারত করহার না কমিয়ে করমুক্ত সীমা অনেক বাড়িয়েছে।'
তিনি মনে করেন, সরকার আগামী দুই বছরের জন্য সম্ভাব্য কর হার ঘোষণা করতে পারে। ন্যূনতম করসীমা বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হলে কম আয়ের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে খুব সামান্যই স্বস্তি পাবে।
২০২৩ সালের মার্চ থেকে দেশে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি। মানুষের প্রকৃত আয় অনেক কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, 'কম আয়ের মানুষের দুর্ভোগ কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। করের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি নাগরিকদের কিছুটা স্বস্তি দিলে তা খুবই ইতিবাচক হবে।'
সর্বোচ্চ কর হার প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, 'ব্যক্তিগত করের হার বাড়ানোর পাশাপাশি করপোরেট করের হার কমানো সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।'
বর্তমানে করপোরেট কর হার ২৫ শতাংশ। ব্যক্তিগত করের হার যদি ৩০ শতাংশ হয়। অর্থাৎ তখন পাঁচ শতাংশের ব্যবধান থাকবে। একটি প্রতিষ্ঠানকে কোন ব্যক্তির মতো সারচার্জ দিতে হয় না। কোন ব্যক্তিকে যদি ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়, তখন কার্যকরী করহার দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশ সারচার্জ দিলে তা বেড়ে হয় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি।
'বেশি আয়ের মানুষের করের বোঝা ভারী হয়ে উঠবে,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'আমরা যদি তাদের ওপর এত বেশি কর আরোপ করি, তাহলে তাদের পুঁজি গঠন কঠিন হয়ে পড়বে। অবশ্যই নীতিটি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত করের হারের মধ্যে যৌক্তিক ফারাক থাকা উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'ব্যক্তিগত আয়করের হার কিছুটা কমানো উচিত। সারচার্জ অক্ষুণ্ণ রেখে তা ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনলে কার্যকর হার দাঁড়াবে প্রায় ২৭-২৮ শতাংশ। বাস্তবে তা হবে ৩২-৩৩ শতাংশ। এটি অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়।'
সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন অব অ্যাকাউন্ট্যান্টসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির মনে করেন, সর্বোচ্চ কর হার আয় বৈষম্য কমাতে কাজ করবে।
তবে তিনি নাগরিকদের ওপর কার্যকর করের হার কমানোর তাগিদ দিয়েছেন।
Comments