আমার গোপন কিছু নেই, কাজ দেখেই হয়তো প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন: ডিএনসিসি প্রশাসক এজাজ
কারও ব্যক্তিগত সুপারিশ বা রাজনৈতিক যোগাযোগের ভিত্তিতে নয়, বরং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ নির্দেশেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক হিসেবে মোহাম্মদ এজাজকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
তিনি আরও দাবি করেন, তার গোপন কোনো কর্মকাণ্ড নেই, সবই প্রকাশ্য। কখনো ধর্মভিত্তিক কোনো গোষ্ঠীর হয়েও কাজ করেননি।
দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ, নদী-খাল রক্ষা, টেকসই নগরায়ন নিয়ে কাজ করা মোহাম্মদ এজাজকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
একজন অ্যাকটিভিস্টকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া, অতীতের কিছু ঘটনা, সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে নিয়ে মন্তব্য ও গরুর হাট ইজারা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন মোহাম্মদ এজাজ।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
নিয়োগ সংক্রান্ত স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, 'যে সুপারিশপত্রটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে, সেটির ভিত্তিতে আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আমাকে আলাদাভাবে একটি প্রসিডিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আমার কোনো গোপন কিছু নেই—আমার সব কাজ প্রকাশ্য, সবাই আমার কাজ দেখেছেন বলেই হয়তো মনে করেছেন যে আমি নগরের ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করতে পারব।'
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সঙ্গে আগে তার কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, 'তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবে গত দুই দশক ধরে আমি নানা জায়গায় বক্তব্য দিয়েছি, পাঠচক্রে অংশ নিয়েছি—হয়তো সেখান থেকেই আমাকে চিনেছেন।'
একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ এজাজ দাবি করেন, এসব পুরোটাই মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফ্রেমিংয়ের অংশ।
'২০০২ সালে আমাকে গ্রেপ্তারের তথ্য মিথ্যা। ২০১৪ সালে ফারাক্কা ইস্যুতে সরকারের কঠোর বিরোধিতা করায় আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেনস্থা করা হয়। আমার ভাড়াটিয়াদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আমাকে তাদের সঙ্গে জড়িয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে কাগজ বানিয়ে আমাকে নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত দেখানো হয়। আমি বলব, এটা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ফ্রেমিং,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'আমি কোনো নিষিদ্ধ বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমার কাজ প্রকাশ্য—আমাকে কাজ দিয়ে বিচার করুন। আমি কখনো কোনো ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলিনি, কাজ করিনি—এর কোনো প্রমাণও কেউ দেখাতে পারবে না।'
প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের পর 'বাইরের লোক' হিসেবে কেমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন, জানতে চাইলে এজাজ বলেন, 'সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ফেস করেছি—রাষ্ট্রযন্ত্র বাইরের কাউকে ওয়েলকাম করে না। আমার টিম আমার কথা বুঝতে পারছিল না। আর দ্বিতীয় হলো—কাজের সুযোগ অনেক কম। পরে ধীরে ধীরে আমার অফিসের লোকজন বুঝতে পারল, আমার কাজের অভিজ্ঞতা আছে, আমি জানি বিষয়গুলো।'
'রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আমি কোনো সহায়তা পাইনি, বরং বাধা পেয়েছি। কোনো দলের কাছ থেকে বা কোনো দলের নেতার কাছ থেকে কোনো সাজেশন পাইনি। যারাই এসেছেন আমার কাছে, তারা আসলে টেন্ডারের জন্য এসেছেন,' বলেন ডিএনসিসি প্রশাসক।
সম্প্রতি কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা করবে। পরে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা ডেঙ্গু প্রতিরোধ নিয়ে কোনো কাজ করছে না।
এমন বিতর্কের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝি। 'আমরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছিলাম, বিশেষ করে সেনাকল্যাণ সংস্থার। তবে সময় স্বল্পতার কারণে সেটা এগোয়নি। আমি হয়তো শব্দচয়ন ঠিকভাবে করিনি। সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব—আমাদের সম্পর্ক ছিল এবং থাকবে,' জানান তিনি।
ঈদে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, 'এবারের ঈদে তিন ধাপে আমরা কাজ করব। প্রায় ১০ হাজার কর্মী বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করবে। তারা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন পর্যন্ত নিয়ে যাবেন। সেখান থেকে এটা ল্যান্ডফিল্ড পর্যন্ত নিয়ে যাবে আরেকটা গ্রুপ। ল্যান্ডফিল্ডে আবার দুটো গ্রুপ কাজ করবে।'
ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডিএনসিসির প্রস্তুতি আছে জানিয়ে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, 'দেড় মাস আগে থেকেই সব হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে, প্রতিটি ওয়ার্ডে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছি। রোগীর সঠিক এলাকা শনাক্তে আমরা ড্যাশবোর্ডের তথ্য ক্রসচেক করছি।'
ডিএনসিসির গরুর হাট পরিচালনার বিষয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এ বছর ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে হাট ইজারা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জোনে আলাদা টেন্ডার বক্স ছিল। কারো অভিযোগ করার সুযোগ নেই। কিন্তু বলতেই হবে—হাট নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। পলিটিক্যাল বা পাওয়ারফুল লোক ছাড়া এটা পরিচালনা কঠিন।'
তিনি জানান, গাবতলী হাটকে পরীক্ষামূলকভাবে এক মাস ডিএনসিসি নিজেরাই পরিচালনা করেছে।
'সে সময়ে গাবতলীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি কালেকশন হয়েছিল। দিনে তিন থেকে চার লাখ টাকা উঠেছে, যেখানে সাধারণত ৭০-৮০ হাজার বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা উঠত,' বলেন তিনি।
কিছুদিন আগে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা সংলগ্ন এলাকায় জাতীয় নাগরিক পার্টির কর্মসূচিতে গরমের সময় ঠাণ্ডা পানি ছিটানোর পর মোহাম্মদ এজাজের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ প্রসঙ্গে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দক্ষিণ সিটির ওয়াটার ক্যানন নেই। রাষ্ট্রীয় সম্পদ—যেখানে দরকার, সেখানে ব্যবহার করাই উচিত। খাল উদ্ধার বা নদী পুনরুদ্ধার যেখানেই হচ্ছে, আমি সেখানে সহযোগিতা করছি।'
তার ভাষ্য, 'রাষ্ট্র মেরামতের এই সময়ে বিভাজনের জায়গা থাকা উচিত না—আমার দপ্তর না হলে আমি করব না, এমন মানসিকতা বাদ দিতে হবে। আমি স্বেচ্ছায় সবার পাশে দাঁড়িয়েছি এবং ভবিষ্যতেও দেবো।'
কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলে দাবি করেছেন মোহাম্মদ এজাজ। তবে, জুলাই অভ্যুত্থানের সক্রিয় কর্মীদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু, সময় দিতে না পারায় পদত্যাগও করেছেন।
তিনি বলেন, 'কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্বে আছি, এ কাজটাই ভালোভাবে করতে চাই।'
'সিটি মেয়র বা অন্য কোনো নির্বাচন নিয়েও আপাতত ভাবছি না,' বলেন তিনি।
Comments