দাম নির্ধারণে সময়ক্ষেপণ, এপ্রিলে বিপিসির গচ্ছা ১১ কোটি টাকার বেশি

ক্রয়মূল্য নির্ধারণে সময়ক্ষেপণের কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিলেও কর্তৃপক্ষের নজর নেই এদিকে।

দেশের বেসরকারি ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্টগুলোতে উৎপাদিত জ্বালানি তেল বিপিসি কিনে নেয়। এই জ্বালানি তেল কেনার ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ করার জন্য উভয়পক্ষের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী 'প্রাইসিং ফর্মুলা' নির্ধারণ করা হয় ২০২২ সালের ১০ অক্টোবরের গেজেট অনুযায়ী।

অভিযোগ রয়েছে, এই ফর্মুলা অনুযায়ী প্রতি মাসের ৭ তারিখ ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে বেসরকারি ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্ট মালিকদের দেওয়া হয় অবৈধ সুবিধা। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো কোনো মাসে ১১-২০ তারিখেও মূল্য নির্ধারণ কমিটি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে থাকে।

মার্চে মূল্য নির্ধারণ কমিটি বেসরকারি ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্ট থেকে অকটেন কেনার ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ করে ৮৫ টাকা ৮১ পয়সা প্রতি লিটার। একই সঙ্গে পেট্রোল ৮১ টাকা ২১ পয়সা এবং ডিজেল ৯০ টাকা ৪ পয়সা নির্ধারণ করে, যা পরবর্তী গেজেট প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকে।

এই মূল্য গেজেট প্রকাশের তারিখ থেকে অর্থাৎ মাসের ৭ তারিখে পরিবর্তন হওয়া কথা থাকলেও তা হয়নি। পরবর্তীতে নতুন মূল্য কার্যকর করা হয় ১১ মার্চ। মূল্য সমন্বয়ে বিলম্ব হওয়ায় মার্চে বিপিসির লোকসান হয়েছে সাত কোটি টাকার বেশি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এপ্রিলে মূল্য নির্ধারণ কমিটি তাদের প্রাইসিং ফর্মুলা অনুযায়ী এসব জ্বালানি তেলের দাম কমায়।

এপ্রিলের জন্য অকটেন ৮০ টাকা ৫৭ পয়সা, পেট্রোল ৭৫ টাকা ৯৭ পয়সা ও ডিজেল ৮৪ টাকা ৬৮ পয়সা মূসকসহ লিটার প্রতি দাম নির্ধারণ করে।

নিয়ম অনুযায়ী ৭ এপ্রিল এই মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় দুপুর ২টায়। সভার কার্যবিবরণীতে কমিটির সদস্যরা সই করেন ৯ এপ্রিল। ফলে, ৭ এপ্রিল থেকে নতুন ক্রয়মূল্য কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এই মূল্য কার্যকর করা হয় নয় দিন পর অর্থাৎ ১৬ এপ্রিল থেকে।

অভিযোগ রয়েছে, এক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্যরা কৌশলে সময়ক্ষেপণ করেছেন এবং চারটি বেসরকারি ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্টের মালিকপক্ষকে প্রায় ১১ কোটি ৩৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকার অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন।

বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে অভিযোগ করে বলেন, 'মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্যরা বেসরকারি ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্ট মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।'

কর্মকর্তারা জানান, ৭ থেকে ১৬ এপ্রিলের মধ্যে বিপিসি চারটি বেসরকারি ফ্র্যাকশন প্ল্যান থেকে অকটেন কিনেছে এক কোটি তিন লাখ ৫২ হাজার ৮২৮ লিটার, পেট্রোল ৭৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৭৮ লিটার এবং ডিজেল ২৪ লাখ ৩১ হাজার ৬৪৪ লিটার।

এই বেসরকারি ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্টগুলো হলো—সুপার পেট্রোকেমিক্যাল লি., অ্যাকোয়া রিফাইনারি লি., পেট্রোমেক্স রিফাইনারি লি. এবং পারটেক্স পেট্রো লি.।

বিপিসি কর্মকর্তারা বলেন, মার্চে ক্রয়মূল্য ছিল বেশি। এপ্রিলে তা কমে যায়। কিন্তু বিপিসির মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্যরা এপ্রিলের ১৬ তারিখ পর্যন্ত বেসরকারি ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্ট মালিকদের বেশি দাম পরিশোধ করেছেন। ফলে বিপিসি ও সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এতে মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্যরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্টরা।

একইভাবে জানুয়ারিতে এই কমিটি প্রাইসিং ফর্মুলা অনুযায়ী অকটেনের দাম ৮৬ টাকা ৬৭ পয়সা, পেট্রোল ৮২ টাকা ৭ পয়সা এবং ডিজেল ৮৯ টাকা ৭৭ পয়সা মূসকসহ লিটার প্রতি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে।

পরের মাসে প্রাইসিং ফর্মুলা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্টে উৎপাদিত অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেলের দাম কমে যায়। নিয়ম অনুযায়ী ৭ ফেব্রুয়ারি মূল্য পুনঃনির্ধারণের জন্য কমিটির সভা করার কথা থাকলেও তা হয়নি। পরবর্তীতে কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় ১১ ফেব্রুয়ারি। নতুন মূল্য কাঠামো ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর করার ঘোষণা দেয় কমিটি।

জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে তেলের দাম কমলেও মূল্য সমন্বয় করতে কমিটি অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ করেছে পাঁচ দিন। ফেব্রুয়ারিতেও সময়ক্ষেপণের কারণে বিপিসি লোকসান দিয়েছে।

অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে দ্রুত মূল্য সমন্বয় করে বেসরকারি ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্ট মালিকদের সুবিধা দিয়ে থাকে বিপিসির মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্যরা।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মূল্য নির্ধারণ কমিটির আহ্বায়ক ও বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এমন আজাদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি বিপিসিতে যোগ দিয়েছি বেশি দিন হয়নি। এ বিষয়ে আমার স্বচ্ছ ধারণা নেই। এমন যদি হয়ে থাকে তাহলে তা কাম্য নয়। সময়ক্ষেপণ করে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।'

বিপিসির মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্য সচিব ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) শাহরিয়ার মো. রাশেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইচ্ছাকৃতভাবে সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভা নির্দিষ্ট সময়ে হয়। সভার রেজুলেশনে কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর নিতে দেরি হওয়ায় সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে কয়েকদিন সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।'

সামগ্ৰিক বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিয়ম অনুযায়ী ক্রয়মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়া সঙ্গে সঙ্গে গেজেট প্রকাশ করতে হয়। এক্ষেত্রে দু-একদিন দেরি হতে পারে। তাই বলে সাত দিন গ্ৰহণযোগ্য নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।'

অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে অ্যাকোয়া রিফাইনারির পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মো. সালাহ উদ্দিন এবং সুপার পেট্রোকেমিক্যালের সিইও প্রণব সাহার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তারা জবাব দেননি।

Comments