জুলাই সনদ হতে পারে গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

ছবি: সংগৃহীত

গণঅভ্যুত্থানের বাস্তবতায় বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের স্বপ্ন ও সংগ্রামের ইতিহাসকে নতুনভাবে লেখার সুযোগ পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে "জুলাই সনদ" নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। অনেকের মনে প্রশ্ন আছে, জুলাই সনদ আসলে কী? এটি কি দেশের মানুষের মুক্তির দলিল হয়ে উঠতে পারে? এ ধরনের সনদে কি লেখা থাকে? এর প্রয়োজনীয়তাই বা কতটা? প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে রাজনৈতিক বাস্তবতা, তত্ত্বীয় ভিত্তি এবং ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষাগুলো একসাথে দেখতে হবে।

জুলাই সনদ আসলে কী?
এক কথায় জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক চুক্তি। দ্বন্দ্বময় এক বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গণআকাঙ্ক্ষা, প্রতিরোধ বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাকে ভিত্তি দিতে এ ধরণের সনদ অপরিহার্য।

যুগে যুগে দ্বন্দ্ব সংঘাতময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে এবং শান্তিপূর্ণ প্রগতিশীল মানব সভ্যতা নির্মাণে মদিনা সনদ, ম্যাগনা কার্টা, জাতিসংঘ সনদের মত বহু সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইতিহাসে গভীর সংকটের মুহূর্তে যখন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য সম্মিলিত ভিত্তি তৈরি করার প্রয়োজন পড়েছে, তখন এ ধরণের সনদের আশ্রয় নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী সরকারের সাথে শুরু হওয়া দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতি যে মৌলিক সমস্যাগুলো থেকে উদ্ভূত হয়েছে তা এখনো নিরসন হয়নি। মৌলিক সমস্যা নিরসনে অংশীজনরা মুখোমুখি অবস্থানে আছে। আইনি ভাবে দুর্বল ভিত্তির এ সরকার গণতন্ত্রের পথে কতটা এগুতে পারবে তা নিয়েও সন্দেহ শুরু হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে জাতিগতভাবে আমরা একটা অনিশ্চিত পথে। ফলে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থসহ এই সার্বিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জুলাই সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কেন প্রয়োজন
আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট জানি। আইনি পথে কাঠামোবদ্ধ ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোনো পথ না থাকায় দেশের আপামর ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকারকে উৎখাত করে। তারা রাস্তায় স্লোগান দিয়ে, দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে, সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানায় যে তারা কী চায়, তাদের আকাঙ্খা কী।

মোটাদাগে, ইতিহাসের এই বিশেষ সময়ে দেশের মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের ঘটনাকে তুলে ধরতে এবং তাদের আশা আকাঙ্খা ধারণ করে পরবর্তী পথ ও পদ্ধতি নির্ধারণ করার জন্য জুলাই সনদ প্রয়োজন। কিন্তু এটুকুতে জুলাই সনদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে সামগ্রীক ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব না। এর জন্য বিশদ আলোচনা দরকার। 

গণ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দলিল

আমরা জানি, এই দেশের জনগণের প্রত্যক্ষ ইচ্ছা ও ক্ষমতায় একটা ফ্যাসিবাদী ও অগণতান্ত্রিক শাসনের পতন হয়েছে। আমরা এই জনগণের অংশ ছিলাম জন্য আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে জানি। কিন্তু এই সত্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে কীভাবে? অথবা আন্তর্জাতিক সমাজ কিভাবে জানবে ও মেনে নেবে? গণমাধ্যমের প্রচারণা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, অথবা মুহাম্মদ ইউনূসের ইনফর্মাল প্রচারণা এক্ষেত্রে মূল্যবান হলেও স্থায়ীভাবে এই ঘটনার গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে যথেষ্ট নয়।

ফলে এই ঘটনাকে কার্যকর ভাবে, তত্ত্বীয় ভিত্তিতে এবং গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত উপায়ে তুলে ধরার একটা উপায় হলো সনদ রচনা করা। এ ধরনের সনদ এমন ঐতিহাসিক ঘটনাকে তুলে ধরার সাথে সাথে জনগণের সার্বভৌমত্বের ঘোষণা হিসেবেও কাজ করে।

এই প্রেক্ষাপটে রুসোর 'পপুলার সভারিনিটি'র ধারণা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। রুসো বলেছিলেন, রাষ্ট্রক্ষমতা জনগণের এবং জনগণের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলনেই প্রকৃত রাষ্ট্রের শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। আর এই "জনগণের সাধারণ ইচ্ছা"কে সুসংহত ও সুনির্দিষ্ট ভাবে একটা সামাজিক চুক্তি হিসেবে প্রকাশ করার কার্যকর মাধ্যম হলো সনদ। 

ফলে সনদের মাধ্যমে যদি জুলাইয়ের জনগণের সাধারণ ইচ্ছাকে তুলে ধরা হয় তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে যে জুলাই অভ্যুত্থানের মূল শক্তি জনগণ। এটা কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী তৎপরতায় ঘটেনি।

অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের আইনি ভিত্তি

অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার গঠন থেকে পরবর্তী বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রয়োজনীয়তার নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। সহজ কথায় "উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায়" প্রয়োজন মতো সামাল দেয়া হয়েছে। অথচ এই নীতি আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। দেশে দেশে উচ্চ আদলতের রায়ে এই নীতি ব্যবহারের সীমা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। এই নীতি স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তি তৈরি করে। গণতন্ত্রের পথে ফিরতে হিমসিম খাওয়া পাকিস্তান বারবার এই নীতিকে আশ্রয় করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে চেয়ে ব্যার্থ হয়েছে। বাংলাদেশেও ৫ম সংশোধনী মামলার রায়ে এই নীতি ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই নীতির ভিত্তিতে গঠিত সরকারের গণতান্ত্রিক চরিত্র নষ্ট হয় এবং এর অধীনের আইনে শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প ও অধিক শক্তিশালী আইনি ভিত্তি হতে পারে অত্মপরিচয়ের নীতি। জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সংক্রান্ত ঘোষণা, ভিয়েনা ঘোষণা, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের একাধিক প্রস্তাব ছাড়াও অন্যান্য আঞ্চলিক জাতিসংস্থার সনদ এই নীতিকে স্বীকার করে। এই নীতি অনুযায়ী জনগণ স্বতন্ত্রভাবে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে এবং নিজেদের জন্য নতুন রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারে।

এই নীতির ভিত্তিতে তৈরী জুলাই সনদ হবে ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতা প্রয়োগের একটা আইনত স্বীকৃত পদ্ধতি। ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই সনদে স্বাক্ষর করার মধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে বলবে, জুলাইয়ের প্রেক্ষাপট কী ছিল, কীভাবে সরকার পরিবর্তিত হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা কী হবে। এভাবে জুলাই সনদ হয়ে উঠবে ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল পক্ষের মধ্যকার একটি চুক্তি। এটি হবে গণভ্যুত্থানের আইনি ভিত্তি দেয়া দলিল। এতে করে প্রয়োজনীয়তার বিতর্কিত নীতি থেকে বেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আত্মপরিচয়ের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের ভিত্তি তৈরি হবে। অভ্যুত্থানের এবং এর পরবর্তী সরকারের আইনত এই ভিত্তি রচনা করা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অংশীজনদের স্বীকৃতি ও দায়বদ্ধতা

অভ্যুত্থানের পর একটি বহুল উচ্চারিত শব্দ হলো "অংশীজন"। কিন্তু অমীমাংসিত প্রশ্ন হলো, এই গণঅভ্যুত্থানে অংশীজন কারা? তারা কীভাবে অংশ নিল? অভ্যুত্থানের পরে তারা দেশের রাজনীতিতে কিভাবে বর্তমান? তাদের অধিকার ও কর্তব্য কী?

আমরা বলি, এটি ছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। বলি, এই ছাত্র-জনতা মিলে অন্তত একটি প্রতীকি নেতৃত্ব স্বীকার করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি। আরো বলি, রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিতভাবে অংশ নিয়েছে। বলি, এই কাতারে আরও ছিল সিভিল সোসাইটি, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, সৈনিক, শ্রমিকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। ফলে এরা সবাই এই অভ্যুত্থানের অংশীজন। সুতরাং প্রথমে এদের সকলের অংশগ্রহণ স্বীকার করতে হবে। সকলের অংশগ্রহণ স্বীকার না করলে এই ঘটনাটি "গণঅভ্যুত্থান" হিসেবে বৈধতা পাবে না।

এরপর আসে দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কারা নিল? কারা মিলে সরকার গঠন করল? স্লোগানে, দেয়ালে, সোশাল মিডিয়ায় ছাত্র-জনতা তাদের কী কী আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করল? সেই আকাঙ্ক্ষার আলোকে সরকার কীভাবে এবং কাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকবে জুলাই সনদে। এই সনদ সরকার সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য ধারণা গড়ে তুলবে। গণতন্ত্রে স্বচ্ছতা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অংশগ্রহণ, দায়িত্ব এবং স্বচ্ছতা এই তিনটি দিক যতটা নির্ভুল, ন্যায্য ও পরিষ্কার করে লেখা যাবে, জুলাই সনদের মর্যাদা ততটাই স্থায়ী, উজ্জ্বল ও গ্রহণযোগ্য হবে।

সাংবিধানিক ও আইনি ধারাবাহিকতা

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার যে তৎপরতা চালাচ্ছে, তা কার্যকর করতে জুলাই সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিদেশি রাষ্ট্র বা বিনিয়োগকারীরা সাধারণত বহুমুখী নিরাপত্তা বিবেচনা করে কোনো রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। যদি দেখা যায়, কোনো রাষ্ট্র বা সরকারের আইনি ভিত্তি নড়বড়ে কিংবা সেখানে আইনের শাসন অনুপস্থিত, তহলে সেখানে ব্যবসায়ীরা অর্থ লগ্নি কিংবা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সম্পর্ক তৈরির ঝুঁকি নিতে চায় না। একইভাবে, বিদেশি সরকারগুলো একটি নড়বড়ে ভিত্তিতে দাঁড়ানো সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।

এ অবস্থায় জুলাই সনদের মাধ্যমে যদি পূর্বের আইনি ধারাবাহিকতা মেনে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের পথ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয় এবং আইনের শাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তবে তা আন্তর্জাতিক পরিসরে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করবে। পাশাপাশি সরকারকেও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে শক্তি যোগাবে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের পথে যে বাধাগুলো আছে, তা কাটিয়ে উঠতে ভূমিকা রাখবে সনদ।

বর্তমানে সাংবিধানিক ও আইনি ধারাবাহিকতা লঙ্ঘনের ভয়ে প্রয়োজনীয়তার নীতিকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছি। অথচ এই পথ প্রশ্নবিদ্ধ, সংকটপূর্ণ, অনিরাপদ এবং অনিশ্চিত। এই বাস্তবতায় জুলাই সনদ হবে আইনি ধারাবাহিকতায় ফেরার নির্ভরযোগ্য পথ। অভ্যুত্থানের মতো একটি ঘটনাকে আইনি ও নৈতিক কাঠামোয় ধারণ করা, তাকে জনভিত্তি দেওয়া, এর কার্যকারণ নির্ধারণ করা, দেশি-বিদেশি সব পক্ষের কাছে আস্থা তৈরি করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং একটি সুন্দর মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পথে জুলাই সনদ হতে পারে একটি ঐতিহাসিক দলিল। জুলাই সনদ হবে এ দেশের জনগণের আত্মপরিচয়ের প্রকাশ। এ সনদ হবে আশা আকাঙ্খার প্রথম ঘোষণা।

সুতরাং, ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আমাদের দায়িত্ব এই সনদটা যথাযথভাবে রচনা করা। যাতে তা হয়ে ওঠে আমাদের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের অনন্য দলিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ সনদ দেখে যেন বলতে পারে, এটাই ছিল সেই মুহূর্ত, যখন বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই জনগণের হাতে ফিরে এসেছিল।

আইনজীবী ও গবেষক

Comments

The Daily Star  | English

Israel army warns 'danger persists' despite ceasefire with Iran

Trump brokered ceasefire agreement in contact with Israel, Iran: White House official

2d ago