মব সন্ত্রাস এখন নিয়মিত ঘটনা

গত ১০ মাসে দেশে মব সন্ত্রাসের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। 'মব জাস্টিসের' নামে এসব হামলার ঘটনা এখন এতটাই নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে অনেক সময় পুলিশের উপস্থিতিতেও এসব ঘটনা ঘটছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সরকার এসব ঘটনায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় জনতা মব সন্ত্রাসে উৎসাহিত হচ্ছে। এতে স্বেচ্ছাচারী 'বিচার' সাধারণ ও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

সংগঠনগুলোর মতে, মব সন্ত্রাসের ঘটনায় পুলিশের ব্যবস্থা নিতে দেরি করা বা হস্তক্ষেপে নিরব মানসিকতার কারণে এসব ঘটনার প্রতি সহানুভূতির বার্তাই দিচ্ছে।

বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, সহিংসতার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরে পুলিশ সক্রিয় হয়েছে ।

এমনকি, জনতা তাণ্ডব চালালেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার ওপর হামলা।

গত ১০ মাসে মব জাস্টিসের নামে ব্যক্তির ওপর হামলা, অফিস ও ঘরবাড়ি লুটপাট, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, মাজার, আখড়া ভাঙা, এমনকি নারীদের ফুটবল ম্যাচ পর্যন্ত বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মব সহিংসতায় অন্তত ১৭৪ জন নিহত হয়েছে।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটনের মতে, 'মব সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ ঘটনার পরও আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না, যা মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি শক্ত বার্তা দিতে পারে।'

রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে মব সহিংসতা বাড়ে কিন্তু এখন এ ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক মাত্রায় ও নিয়মিত ঘটছে বলে জানান তিনি

তিনি বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়ি জনসমক্ষে ঘোষণা দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সরকার তখন তা ঠেকাতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি। বরং যারা এই কাজ করেছে, তারা গর্বের সঙ্গে নিজেদের কৃতকর্ম উদযাপন করেছে।'

তিনি জানান, সরকারের নির্লিপ্ততা এমন একটি বার্তা দেয় যে সরকার 'মব সন্ত্রাস' করলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেবে না ।

গত রাতে এক বিবৃতিতে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জানায়, গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে যে মব সন্ত্রাসের ঢেউ শুরু হয়েছিল, তা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

এ মাসের ২২ জুন সাবেক সিইসি নুরুল হুদার ওপর হামলার ঘটনার পর গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সরকার মব সন্ত্রাস পুরোপুরি থামাতে পারেনি, তবে ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

মব সন্ত্রাসে অংশগ্রহণকারী কতজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ঠিক কতজন তা আমি জানি না… তবে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।'

তিনি আরও জানান, সহিংসতা রোধে অবহেলা পাওয়া গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও শাস্তি দেওয়া হবে।

সাবেক সিইসি নুরুল হুদার ওপর হামলার প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাড়িতে ঢুকে তাকে মারধর করেন এক দল ব্যক্তি। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকজন গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে লাঞ্ছিত করছেন। মুখে মারছেন। এরপর ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত হলে পুলিশের হাতে তাকে তুলে দিচ্ছেন।

গতকাল এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হামলায় জড়িত সন্দেহে হানিফ মিয়া নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী ।

এছাড়া রোববার লালমনিরহাট শহরে এক নরসুন্দর ও তার ছেলেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে মারধর করা হয় এবং পরে পুলিশ তাদের আটক করে।

গতকাল এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা দাবি করেছে, প্রত্যেক ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হোক এবং দোষীদের আইনের আওতায় আনা হোক। এছাড়া এমন ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য পুলিশ বাহিনী কার্যত দৃশ্যমান ছিল না। তখন মব সহিংসতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মব সহিংসতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ নিহত হন। পরে শামীম হত্যায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হোসেনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা চোর সন্দেহে মারধর করে হত্যা করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আট শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে। এ ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব অনুসন্ধান ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশজুড়ে ৭০টিরও বেশি মাজার ও আখড়ায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, ১৮ জানুয়ারি অন্তত ৪০টি মাজারে হামলার ঘটনায় ২৩ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা ৫ আগস্টের পরের ঘটনা।

৬ মার্চ গুলশানে শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ছেলে তানভীর ইমামের ফ্ল্যাট দাবি করে ভাঙচুর করে একদল জনতা। অবৈধ অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ লুকানো আছে এমন অভিযোগে পুলিশের উপস্থিতিতেও দরজা ভেঙ্গে ফেলে উত্তেজিত জনতা। পরে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।

মে মাসে হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক গোলাম মোস্তাফাকে 'ফ্যাসিস্টের দোসর' দাবি করে তার বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করে একদল লোক।

পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে প্রকাশককে গ্রেপ্তার করতে বলে তারা। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকায় গ্রেপ্তার করা যাবে না জানালে পুলিশের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয় তারা।

এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তিনজনকে আটক করে, যার মধ্যে একজন 'স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট ডিসক্রিমিনেশন' সংগঠনের সাবেক নেতা।

পরে জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদের উপস্থিতিতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে না মর্মে মুচলেকা দিলে তিনজনকে পুলিশ ছেড়ে দেয়।

মে'র ৯ তারিখে মুন্সিগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনালে নিহাল আহমেদ জিহাদ নামে এক ব্যক্তি দুই নারীকে লঞ্চের ক্যাবিন থেকে জোরপূর্বক বের করে এনে শতাধিক যাত্রীর সামনে তাদের বেল্ট দিয়ে পেটান।

পরবর্তীতে নিহালকে গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু তিন সপ্তাহ পর জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। জেল থেকে বের হওয়ার সময় তাকে মালা দিয়ে বরণ করে একদল লোক।

রংপুর, দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে তিনটি নারী ফুটবল ম্যাচ এমন কয়েকটি গোষ্ঠী বন্ধ করে দেয় যারা বলেছিল এসব আয়োজন ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর এসব ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।

এক দশকের মধ্যে গত ১০ মাসে মব সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত অন্তত ১৭৯ জন মব হামলায় নিহত হয়েছেন।

গত ১০ মাসে মাসে গড়ে ১৭ দশমিক ৯ জন মব হত্যার শিকার হয়েছেন, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৫ সালে মাসিক গড় ছিল ১১ দশমিক ২৫।

বছরভিত্তিক মব হত্যার সংখ্যা—২০১৬ সালে ৫১ জন, ২০১৭ সালে ৫০ জন, ২০১৮ সালে ৩৯ জন, ২০১৯ সালে ৬৫ জন, ২০২০ সালে ৩৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২৩ সালে ৫১ জন

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মব হামলায় ৩২ জন নিহত হয়েছেন। গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৯৬ জন মব হামলায় নিহত হয়েছেন।

তবে এ বছর এখন পর্যন্ত অন্তত ৮৩ জন মব হামলায় মারা গেছেন।

মব সন্ত্রাস রোধে সরকারের হুঁশিয়ারি কাজে আসছে না

বারবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দিলেও তা কাজে আসেনি।

গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, সরকার মব সহিংসতা বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ্য করবে না।

সেই একই দিনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর বলেন, 'যদি কেউ অপরাধ করে, তাহলে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করতে হবে। নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।'

এ বছরের মার্চের ৬ তারিখে তিনি বলেন, যে কোনো জায়গায় মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলে সরকার আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে।

ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, 'সরকার তথাকথিত আন্দোলন ও মব ড্রিলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।'

পরের মাসে তিনি জানান, 'এখন থেকে সরকার যেকোনো ধরনের 'মব জাস্টিসের' বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।'

তবে সরকারের এসব পদক্ষেপের বিষয়ে আইনজীবী সারা হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনাতেই আমরা সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দেখছি। তারা বলে তারা সহ্য করবে না। কিন্তু সহ্য না করার মানে কী?

তিনি আরও বলেন, 'স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এসব হামলা ঠেকাতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে, কারণ মব হামলায় ১৭৯ জন মারা গেছেন। যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের শনাক্ত করা উচিত। সরকার এখনই পদক্ষেপ না নিলে এসব থামবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

CEC Nasir Uddin calls on chief adviser

The meeting was held at the state guest house Jamuna

53m ago