আকাশ ও স্থলপথে মাদক পাচার বাড়ছে

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে বিমানবন্দর এবং সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে মাদক পাচার বেড়েছে। স্থানীয় মাদক চোরাকারবারে ফেনসিডিল এবং গাঁজার আধিপত্য দেখা গেছে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটগুলো বাংলাদেশকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে আগের চেয়ে বেশি ব্যবহার করতে শুরু করায় কোকেন চোরাচালান, বিশেষ করে আকাশপথে, আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তাদের মতে, এসব কোকেন স্থানীয়ভাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে আনা হয় না, বরং তা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাঠানোর জন্যই এখানে আনা হয়।
২০২৪ সালের বার্ষিক মাদক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ১৩০ কেজি কোকেন জব্দ করেছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ১৩ কেজি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আজ মাদকের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালন করার সময় এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তালিকাভুক্ত বহু মাদক চোরাকারবারি এখনো সক্রিয়, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা ও বড় বড় শহরে। তারা মাদক পরিবহনের কাজে ছোটখাটো অপরাধী, দিনমজুর ও রিকশাচালকদের নিয়োগ করছে।
কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, সাতক্ষীরা, পঞ্চগড় এবং দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ফেনসিডিল, গাঁজা এবং হেরোইন পাচার হচ্ছে। যা ২০০৫ সালের পর প্রায় দুই দশক ধরে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা-নির্ভর মাদক বাণিজ্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কর্মকর্তাদের মতে, গত কয়েক বছর ধরে ইয়াবার সরবরাহ এবং ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেনসিডিল, হেরোইন এবং গাঁজা এখন স্থানীয় মাদক চোরাকারবারের উপর আধিপত্য বিস্তার করছে, যার একটা কারণ হলো কিছু অঞ্চলে ইয়াবা এবং অন্যান্য সিনথেটিক মাদকের অপ্রতুলতা।
প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে ৪ কোটি ২৯ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হলেও ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৮ লাখে। একইভাবে, ক্রিস্টাল মেথের জব্দের পরিমাণ ১৮৬ কেজি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১১০ কেজিতে।
মাদক চোরাকারবারে এ পরিবর্তনের বিষয়টি নিশ্চিত করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ বদরুদ্দিন বলেন, 'ভারত থেকে চালান আসছে, আমরা তা জানি। সম্প্রতি হেরোইনসহ বেশ কয়েকটি চালান জব্দ করা হয়েছে।'
অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (গোয়েন্দা) খোরশেদ আলমও একই মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পাচারের হটস্পটের সংখ্যা বেড়েছে।
২০২৪ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৫ লাখ ৭২ হাজার বোতল ফেনসিডিল জব্দ করে, যেখানে ২০২৩ সালে জব্দ হয়েছিল ৪ লাখ ৮২ হাজার বোতল। গাঁজা জব্দের পরিমাণও ১ লাখ ১২ হাজার কেজি থেকে বেড়ে ১ লখ ১৪ হাজার কেজি হয়েছে।
স্থানীয় মাদক চোরাকারবারির বরাতে জানা যায়, প্রতি বোতল ফেনসিডিল ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হয়, যেখানে গাঁজার দাম ৬৪ হাজার টাকা প্রতি কেজি। প্রতি কেজি হেরোইনের দাম ২০ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকার মধ্যে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ফেনসিডিল ও গাঁজা ভারত থেকে পাচার হয়ে আসে—যার জন্য ব্যক্তিগত যানবাহন, মোটরসাইকেল এবং কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করা হয়। এরপর এসব মাদক শহরাঞ্চলে সরবরাহ করা হয়।
কোকেন চোরাচালান
পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীরা বাংলাদেশকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কোকেন সরবরাহের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কোকেনের একটি চালান জব্দের পর স্থানীয় মাদক চোরাকারবারিদের সঙ্গে মালাওয়ি, ক্যামেরুন ও নাইজেরিয়ার নাগরিকদের গ্রেপ্তার করা হয়। সন্দেহভাজন চক্রের প্রধান একজন নাইজেরিয়ান নাগরিক এখনো পলাতক।
খোরশেদ আলম বলেন, 'চোরাচালানকারীরা পেরু এবং কলম্বিয়া থেকে কোকেন নিয়ে আসে এবং পরে মূলত ইউরোপে পাচার করে।'
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. বদরুদ্দিন বলেন, কোকেন শুধুমাত্র আকাশপথেই পাচার করা হয়। জনবল ও সরঞ্জামের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা পাচারকারীদের গ্রেপ্তার ও চালান জব্দে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, 'এই ধরনের চালান আরও ভালোভাবে শনাক্ত করার জন্য বিমানবন্দর এবং সীমান্ত চেকপয়েন্টে বডি স্ক্যানারসহ আরও সরঞ্জাম স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
নতুন মাদক পাচারকারীদের তালিকা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক বৈঠকে দেশজুড়ে মাদক পাচার বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করার পর পুলিশ সদর দপ্তর সব জেলার পুলিশ সুপারদের মাদক পাচারকারীদের নতুন তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে।
পাচারকারীদের আস্তানা ধ্বংস, নতুন এবং পুরোনো পাচারকারীদের শনাক্ত এবং বিচারাধীন মাদক মামলার তদন্তের জন্য অভিযান জোরদার করার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক সাগর বলেন, 'সীমান্ত এলাকায় সতর্কতা জোরদার করা হয়েছে। মাদকপাচার রোধে আমরা অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় করছি।'
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি স্থানীয় সিন্ডিকেটের মূল হোতারা নাইজেরিয়া, ঘানা, ভারত এবং মিয়ানমারের মাদক পাচারকারীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখছে। ঢাকা, কক্সবাজার, কুমিল্লা, সিলেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহীসহ কমপক্ষে ৩২টি জেলায় মাদক পাচারকারীরা অত্যন্ত সক্রিয়।
তারা আরও জানান, কিছু পুলিশ সদস্যও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন উপ-মহাপরিদর্শক স্বীকার করেছেন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যবেক্ষণে কিছু শিথিলতা ছিল।
তিনি বলেন যে পুলিশ এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক চোরাকারবারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে। ঢাকা, কক্সবাজার এবং অন্যান্য অঞ্চলে ইতোমধ্যে শতাধিক সন্দেহভাজন পাচারকারীকে শনাক্ত করা হয়েছে।
Comments