গাজায় ‘জাতিগত নিধনে’ যত ইসরায়েলি পদ্ধতি

গাজায় খাবারের জন্য অপেক্ষা। ফাইল ছবি: এএফপি

গাজার শিশুদের নিয়ে ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার কবি মাহমুদ দারবিশ লিখেছিলেন, 'প্রতিদিনই জন্ম নেয় যে নতুন শিশুরা/তারা ঘুমোতে যাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে; মৃত্যুতে।/তাদের গণনা করা মূল্যহীন।'

আবার গাজার শিশুদের নিয়ে লেখা 'ঘুমপাড়ানি গানে' মায়ের কোলে শুয়ে থাকা বাচ্চার কপালে চুমু এঁকে দেওয়ার জন্য চাঁদের খোঁজ পাননি উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। কারণ চাঁদ ব্যস্ত ছিল ওই মৃত্যু উপত্যকার বাসিন্দাদের সমাহিত করার কাজে।

তাই সেখানকার বেঁচে থাকা শিশুদের ফয়েজ সান্ত্বনা দেন এভাবে—'না বাছা, কেঁদো না!/তোমার বাসভূমে/মৃতদের গোসল দিয়েছে সূর্য/চাঁদ দিয়েছে কবর।'

ফিলিস্তিনি জাতির আকার কমিয়ে আনতে প্রায় আট দশক ধরে দখলদার ইসরায়েলিদের বন্দুক-বোমার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে ছিল এই শিশু ও নারীরা। এ দফাতেও প্রায় ২১ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত হয়েছে ১৬ হাজারের বেশি শিশু। সে হিসেবে প্রতি ৪০ মিনিটে একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

পুরো পৃথিবীর ভেতর গাজাই সম্ভবত সেই জনপদ, যেখানে মাতৃগর্ভেই হত্যার শিকার হচ্ছে শিশুরা। হাসপাতাল-স্কুলসহ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান বলে বিবেচিত শরণার্থী শিবিরগুলোতেও চলেছে বাছবিচারহীন হামলা।

গত শুক্রবার ইসরায়েলের হারেৎজ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এটি এখানকার মোট জনসংখ্যার প্রায় চার শতাংশ।

নিহত ফিলিস্তিনিদের এ সংখ্যা হামাস-নিয়ন্ত্রণাধীন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। এ মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৩০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন।

বিনাশের যত পদ্ধতি

হারেৎজ বলছে, ইসরায়েলি হামলায় সরাসরি নিহত হওয়ার পাশাপাশি বহু মানুষ পরোক্ষ কারণেও প্রাণ হারিয়েছেন। যেমন—অনাহার, ঠান্ডা ও রোগে ভুগে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে নির্বিচার হামলার শুরুর দিকেই ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় খাবার, পানি ও জ্বালানি সরবরাহে বাধা দিতে থাকে। ইচ্ছা করেই উপত্যকাটিতে মানবিক সহায়তার প্রবেশ ঠেকিয়ে দেয়। তছনছ করে দেয় কৃষিজমি। বেঁচে থাকার জন্য যা যা জরুরি, তা থেকে বঞ্চিত করা হয় সাধারণ মানুষকে। তৈরি করা হয় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় একের পর এক হাসপাতাল। চলতে থাকে টার্গেট কিলিং।

সর্বশেষ গতকাল রোববার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান যুদ্ধে ইসরায়েল আরোপিত অবরোধে শিশুদের দুধসহ অন্যান্য পুষ্টিকর ও সম্পূরক খাবার প্রবেশে বাধার কারণে গাজায় পুষ্টিহীনতায় মারা গেছে অন্তত ৬৬ শিশু।

আর জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, কেবল মে মাসেই তীব্র অপুষ্টির শিকার ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী অন্তত পাঁচ হাজার ১১৯ শিশুকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছিল, দখল করা গাজায় বেসামরিক মানুষকে ক্ষুধার মুখে ফেলাকে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল। এখন ত্রাণকেও এখানে হত্যার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

দুই মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার আগেই গত ২ মার্চ থেকে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে প্রায় তিন মাস পর মে মাসের শেষ দিকে কিছু ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে তৈরি গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের এক বিতর্কিত সংগঠনের মাধ্যমে।

এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই জিএইচএফ'র বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে আসা শত শত ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়াও, গতকাল শনিবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়—জিএইচএফ'র মাধ্যমে বিতরণ করা আটার বস্তায় আফিমজাত ওষুধ অক্সিকোডন ট্যাবলেট পাওয়া গেছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম মিডল ইস্ট আই বলছে, অক্সিকোডন একটি আফিমজাতীয় ওষুধ, যা তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা উপশমের কাজ করে। সাধারণত ক্যানসার রোগীদের এই ওষুধ দেওয়া হয়। এটি অত্যন্ত আসক্তিকর এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা ও দৃষ্টিবিভ্রমসহ প্রাণঘাতী প্রভাব ফেলতে পারে।

অথচ আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) পরিচালিত ত্রাণবাহী জাহাজ 'ম্যাডলিন'কে গাজায় ভিড়তে দেয়নি ইসরায়েল। ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য ইতালি থেকে জাহাজটিতে করে ত্রাণ নিয়ে আসা হচ্ছিল।

জাতিগত নিধনের উদ্দেশ্য নিয়েই অভিযান শুরু

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে তিন লাখ ৭৭ হাজার মানুষ 'নিখোঁজ' হয়েছেন; তাদের অর্ধেকই শিশু।

গত বছরের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করে—ইসরায়েল গাজাবাসীর বিরুদ্ধে 'জাতিগত নিধন' (জেনোসাইড) চালাচ্ছে।

বিপরীতে ইসরায়েল এই অভিযোগ অস্বীকার করে।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অ্যামনেস্টির এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন সংস্থার মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড। প্রতিবেদনে বলা হয়, জেনোসাইড কনভেনশনে নিষিদ্ধ পাঁচটি কর্মকাণ্ডের অন্তত তিনটি ঘটিয়েছে ইসরায়েল। এর মধ্যে রয়েছে হত্যাকাণ্ড, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন এবং সুরক্ষিত গোষ্ঠীকে ধ্বংসের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের জীবনমানের ক্ষতি করা।

অ্যাগনেস ক্যালামার্ড আরও বলেন, গাজায় যে জাতিগত হত্যা চালানো হচ্ছে, তা প্রমাণ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রথমে কাজ শুরু করেনি অ্যামনেস্টি। তবে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বিবৃতি পর্যালোচনার পর তারা এই উপসংহারেই পৌঁছান যে গাজায় 'জাতিগত হত্যা' চালানোর উদ্দেশ্য নিয়েই অভিযান শুরু করেছিল ইসরায়েল।

এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাগনেস ক্যালামার্ডের এই ভাষ্য আরও বাস্তব বলেই প্রতীয়মান হয়।

জাতিগত নিধন কী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল জার্মানির নাৎসি বাহিনী। পরে ১৯৪৮ সালে জাতিগত হত্যাকাণ্ড সনদ (জেনোসাইড কনভেনশন) বাস্তবায়ন করা হয়। ওই সনদ অনুযায়ী, 'কোনো জাতি, জাতিগত গোষ্ঠী, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে নির্মূল করার লক্ষ্যে চালানো কর্মকাণ্ডকে' জাতিগত হত্যাকাণ্ড বলে সংজ্ঞায়িত করা যাবে।

এক্ষেত্রে গত শুক্রবার প্রকাশিত হারেৎজের প্রতিবেদন বিষয়টিকে আরও বেশি পোক্ত করে।

একুশ শতকে মৃত্যুর এমন হার আর কোনো সংঘাতে দেখা যায়নি

হারেৎজের প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের হোলোওয়ে কলেজের অর্থনীতিবিদ ও সহিংস সংঘাতে মৃত্যুর বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষক অধ্যাপক মাইকেল স্পাগাটের এক গবেষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

গবেষণাটিতে গাজার প্রায় ১০ হাজার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে দুই হাজার পরিবারের ওপর জরিপ চালানো হয়। এর ভিত্তিতে জানা যায়, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৭৫ হাজার ২০০ মানুষের সহিংস মৃত্যু হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন ইসরায়েলি হামলায়। নিহতদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই নারী ও ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু।

ঘটনাটিকে 'একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘাত' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অধ্যাপক স্পাগাট। তিনি বলেছেন, 'সিরিয়া, ইউক্রেন ও সুদানে যুদ্ধে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা গাজার তুলনায় হয়তো বেশি। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও যোদ্ধাদের মৃত্যুর হার এবং জনসংখ্যা অনুপাতে মৃত্যুর হারে গাজা সম্ভবত শীর্ষে।'

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'আমার ধারণা, গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় চার শতাংশ ইতোমধ্যে নিহত হয়েছে। একুশ শতকে মৃত্যুর এমন হার আর কোনো সংঘাতে দেখা যায়নি।'

মাইকেল স্পাগাটের গবেষণার তথ্য অনুসারে, গাজায় সহিংস মৃত্যুর শিকার নারী ও শিশুদের অনুপাত প্রায় সব সাম্প্রতিক সংঘাতের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। কসোভোয় এ হার ছিল ২০ শতাংশ, উত্তর ইথিওপিয়ায় নয় শতাংশ, সিরিয়ায় ২০ শতাংশ ও সুদানে ২৩ শতাংশ।

গতকাল শনিবারও অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এক দিনে ৬০ জন নিহত হওয়ার খবর এসেছে। এর ভেতর গাজা শহরের তুফাহ এলাকায় দুই দফায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় কয়েকটি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে  অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত নয়টি শিশু।

এভাবে কৌশলে, ঠান্ডা মাথায়, সুপরিকল্পিত এসব হত্যাকাণ্ডকে জাতিগত নিধন ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?

Comments

The Daily Star  | English

'Interim govt ready to hand over power to elected representatives'

Chief Adviser Yunus says while addressing a views-exchange meeting with Bangladeshi expats in Kuala Lumpur

3h ago