ধর্ষণ নিয়ে পুলিশের বিবৃতিতে কেন ‘প্রবাসীর স্ত্রী’

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

২৮ জুন ২০২৫। রাত তখন আনুমানিক ১১টা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক স্ক্রল করতে করতেই চোখে পড়ল কয়েকজনের সদ্য দেওয়া স্ট্যাটাস; কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ। আরেকটু স্ক্রল করতেই ভেসে এলো সেই বীভৎস ভিডিও।

সম্পূর্ণ বিবস্ত্র এক নারীর আর্তনাদ, তাকে ঘিরে একাধিক পুরুষের আস্ফালন, নির্যাতনের চিত্র। একের পর এক ভেসে আসতে লাগল 'আনসেন্সরড' সেই ভিডিও ফুটেজ। স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমের এক বিস্তারিত ভিডিও প্রতিবেদনও ততক্ষণে ভাইরাল হয়েছে।

একাধিক সংবাদমাধ্যম মারফত জানা গেল: কুমিল্লার মুরাদনগরের একটি গ্রামে ঘরের দরজা ভেঙে ২৫ বছর বয়সী এক হিন্দু নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় শুক্রবার দুপুরে মুরাদনগর থানায় ভুক্তভোগী নিজেই মামলা করেছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ ঘটনায় প্রধান আসামি ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

একজন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠল, মারধরের ভিডিও করা হলো এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিও ফুটেজ দেদার মানুষ শেয়ার করল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ধর্ষণের মতো একটা ঘৃণিত অপরাধ নিয়ে অনেকেই রাজনীতি করলেন, তাদের সুবিধামতো বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করলেন। এসব নিয়ে আমার তেমন কিছু বলার নেই। আমার চোখ আটকে গেল কুমিল্লার পুলিশ সুপারের সই করা এক প্রেস রিলিজে, যে প্রেস রিলিজ ফেসবুকে শেয়ার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও।

প্রেস রিলিজের প্রথম প্যারায় 'একজন প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ' লেখা বাক্যটিতে বিশেষভাবে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে। আপাতদৃষ্টে সরলভাবে লেখা এ বাক্যে হয়তো আমাদের দেশের ৯৫ শতাংশ পুরুষ, এমনকি অধিকাংশ নারীও কোনো সমস্যা খুঁজে পাবেন না। কিন্তু এখানেই গুরুতর সমস্যা রয়েছে।

একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, সেটা বোঝাতে পরিষ্কারভাবে 'নারী' না লিখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা লিখেছেন 'প্রবাসীর স্ত্রী'। তিনি কেন এটা লিখলেন?

কারণ, এই সমাজ-রাষ্ট্র-সরকার পুরুষতন্ত্রের বয়ান দ্বারা প্রভাবিত। এই আচরণকে শুধু পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বললে সূক্ষ্মভাবে নারীবিদ্বেষী মানসিকতাকে আড়াল করা হবে। নারীর প্রসঙ্গ এলেই কেন তার পরিচয় হয়ে যায় অমুকের স্ত্রী, তমুকের মেয়ে বা এরকম কোনো কিছু?

একটু গভীরভাবে ভাবলে এবং বাংলাদেশের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচিত কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, 'প্রবাসীর স্ত্রী'—এই সাধারণ শব্দবন্ধের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে নারীকে হেয় করা এবং তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটা ইঙ্গিতও।

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা সোয়া এক কোটি থেকে দেড় কোটি। এর অধিকাংশই পুরুষ ও শ্রমিক। মূলত এই প্রবাসী শ্রমিকদের স্ত্রীদেরই 'প্রবাসীর স্ত্রী' হিসেবে অভিহিত করা হয়। কখনো কখনো ঠাট্টার ছলে 'স্বামী বিদেশ' শব্দবন্ধটিও ব্যবহার করা হয়। আপাতদৃষ্টে সরলভাবে বলা এ কথার মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত নোংরা, বিকৃত ইঙ্গিত।

এ রকম পটভূমিতে ধর্ষণের মতো একটি সংবেদনশীল ইস্যুতে 'প্রবাসীর স্ত্রী' শব্দবন্ধ ব্যবহার করা কতটা যৌক্তিক? এই শব্দগুচ্ছের ব্যবহার কি নিছকই ভুল, জ্ঞানের অভাব, নাকি এর পেছনেও রয়েছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য?

একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, সমাজে প্রচলিত বেশির ভাগ নোংরা গালিগুলো নারীকেন্দ্রিক। এর কারণ হলো, নারীকে সংজ্ঞায়িত, উপস্থাপিত করা হচ্ছে পুরুষের মা, স্ত্রী, বোন বা মেয়ে হিসেবে। এই ভাষার রাজনীতি সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে না। এতে অনেকেই নিজের অজান্তে নারীবিদ্বেষী এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ধারক-বাহক হয়ে যাচ্ছেন।

মোটাদাগে এগুলো হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক ভাষার রাজনীতি। এর মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয় নারীর কোনো নিজস্ব সত্তা নেই, অস্তিত্ব নেই। সে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল এবং পুরুষের অধস্তন। পুরুষতান্ত্রিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ এই শব্দগুলো। এ ধরনের শব্দগুলো বারবার নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। আর যতদিন নারীর জন্য এ ধরনের শব্দের ব্যবহার বন্ধ না হবে, ততদিন নারীকে মানুষ বলে গণ্য করা হবে না।

সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো শুধু 'অশিক্ষিত' বা প্রান্তিক শ্রেণির মানুষই নয়, এসব 'নারীবিদ্বেষী' শব্দ সরকারিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যতদিন এসব শব্দের ব্যবহার বন্ধ না হবে, ততদিন মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর যতদিন এই মানসিকতা পরিবর্তন না করা যাবে, ততদিন এই রাষ্ট্রে নারী মানুষের মর্যাদা পাবে না, নিরাপদ হবে না।

শাকিলা জেরিন: নারী অধিকারকর্মী

Comments

The Daily Star  | English

Money laundering: NBR traces Tk 40,000cr in assets abroad

The National Board of Revenue has found assets worth nearly Tk 40,000 crore in five countries which it believes were bought with money laundered from Bangladesh, said the Chief Adviser’s Office yesterday.

4h ago