বর্ষায় যেভাবে যত্নে রাখবেন আদরের পোষা প্রাণীটিকে

বিড়াল, পোষা প্রাণী,
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীতে মানুষ নেই, সভ্যতা নেই। জলোচ্ছ্বাসে একা ভেসে যায় ছাই রংয়ের ছোট্ট বিড়ালটি। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। ডুবন্ত শহরের নিচে জেগে আছে ধ্বংসের স্মৃতি। একসময় ঝড় থামে, শুরু হয় অবিরাম বৃষ্টি। লেপ্টে থাকা কাদা-মাটিতে ভেজা নিঃসঙ্গ বিড়ালটি একাই হাঁটতে থাকে। খুঁজে চলে আশ্রয়, উষ্ণতা আর জীবনের স্পর্শ।

বৃষ্টি বা বর্ষা মৌসুম চারপেয়ে পোষা প্রাণীদের জন্য কতটা উদ্বেগজনক হতে পারে, তার অনেকটাই ধরা পড়ে সম্প্রতি অস্কার পাওয়া অ্যানিমেশন মুভি 'ফ্লো'তে। বাস্তবেও তার ব্যতিক্রম নয়।

আমাদের মতো বৃষ্টিভেজা স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার প্রভাব পড়ে পোষা প্রাণীর ওপরও। ঠাণ্ডা লাগার পাশাপাশি রোগজীবাণুর সংক্রমণ কাবু করতে পারে আপনার আদরের কুকুর, বিড়াল বা পাখিটিকে। সারাদিন ঘরবন্দি থাকলে ভুগতে পারে বিষণ্ণতায়ও।

পোষা প্রাণীরা আমাদের পরিবারের অংশ। বর্ষায় তাদের সুস্থ রাখতে একটু বাড়তি যত্ন নেওয়া আমাদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। এই সময়টায় আদরের পোষা প্রাণীটিকে নিরাপদ, সুস্থ ও খুশি রাখতে আপনার ভালোবাসার স্পর্শের সঙ্গে বিশেষ এই যত্নও প্রয়োজন।

অসুখ-বিসুখ

বর্ষার সময়টাতেই কুকুর-বিড়াল সবচেয়ে বেশি রোগ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। ভেজা-স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার পাশাপাশি কোনো কারণে শরীর ভিজে গেলে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এ প্রসঙ্গে শের-ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালের সার্জন ডা. রূপ কুমার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্ষাকালটা আমাদের দেশে খুবই রহস্যময়। এই বৃষ্টি, আবার একটু পরই খরখরে রোদ। এমন পরিবেশ লোমশ পোষা প্রাণীদের জন্য খুব একটা সুখকর নয়। বিশেষ করে কুকুর-বিড়ালরা এসময়ে ত্বকের সংক্রমণে ভোগে।'

এ সময়টা কুকুর-বিড়াল কানে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ভোগে বলে জানান ডা. রূপ কুমার। তিনি পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত ল্যাপটোস্পাইরোসিস রোগ নিয়ে সতর্ক করেছেন।

ভেটেরিনারি সার্জন ডা. রূপ কুমার বলেন, 'এ রোগে আক্রান্ত হলে কুকুর-বিড়ালরা একটু পর পর মূত্র ত্যাগ করে। এটি খুব সহজে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।'

এছাড়া, টিকস (Ticks) ও ফ্লি'স (Fleas) নামে দুই ধরনের ক্ষতিকর পরজীবীর সংক্রমণ বেড়ে যায় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এই প্রাণীরোগ বিশেষজ্ঞ আরও জানান, ভেজা আবহাওয়ার কারণে কুকুর-বিড়ালের ত্বকে র‌্যাশ হতে পারে। ঠাণ্ডাজনিত রোগ ক্যানাইন ফ্লুতেও আক্রান্ত হতে পারে। ছোঁয়াচে ভাইরাসের কারণে এটি হয়ে থাকে।

করণীয়

ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালের সার্জন ডা. রূপ কুমার বলেন, এ সময়টায় প্রিয় পোষা প্রাণীর বাড়তি যত্নের পাশাপাশি কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকাও জরুরি।

শুকনো রাখা: সবার প্রথমে পোষা প্রাণীটিকে শুকনো রাখার ওপর জোর দেন ডা. রূপ কুমার। বলেন, ভিজে গেলে দ্রুত শুকনো তোয়ালে দিয়ে ভালো করে গা মুছে দিতে হবে।

উষ্ণ আশ্রয়: ঠাণ্ডা পরিবেশে যেন ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত না হয়, সেজন্য কুকুর বা বিড়ালকে পানি জমে আছে বা স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে—এমন জায়গা থেকে দূরে রাখতে হবে। বাইরে রাখা কুকুরদের জন্য ওয়াটারপ্রুফ ছাউনি বা বিশেষ ঘরের ব্যবস্থা থাকা উচিত।

পরিচ্ছন্নতা: অন্তত ৩ দিন পরপর পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে ভালোভাবে শরীর মুছে দিতে হবে।

বর্ষা মৌসুমে মশা-মাছিসহ কীটপতঙ্গের উৎপাত বাড়ে। এর সংস্পর্শে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হতে পারে বলেও সতর্ক করেন ভেটেরিনারি সার্জন।

পোষা প্রাণী, কুকুর, বিড়াল,
ছবি: স্টার

খাবার ও স্বাস্থ্য

বর্ষাকালে কুকুর-বিড়ালসহ অন্য প্রাণীদের মধ্যে খাবারে অনীহা দেখা দেয়। এ সময়ে তাদের খাদ্যাভ্যাসে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

বর্ষাকালে যেহেতু পেটে গোলমাল হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই প্রতিদিন তাজা ও শুকনো খাবার দেওয়া উচিত।

বর্ষায় খাবার ভিজে গেলে তা সহজে নষ্ট হয়, ফলে খাদ্যে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।

বিশুদ্ধ পানি খাওয়ানোর পাশাপাশি কুকুর-বিড়ালের পানির পাত্র ও আশপাশের জায়গাটি পরিষ্কার রাখতে হবে।

বর্ষা মৌসুমে পোষা প্রাণীদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা একটু দুর্বল হয়ে পড়ে। এজন্য পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাবারের ওপর জোর দেন ডা. রূপ কুমার।

মন ভালো রাখা

বর্ষায় সারাদিন ঘরবন্দি থেকে প্রিয় বিড়াল বা কুকুরটির বিষণ্ণ হয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। তাই বাড়িতেই ওদের সঙ্গে খেলাধুলা করা উচিত, যেন শরীর ও মন ভাল থাকে।

বর্ষাকালে কুকুর-বিড়ালের যেসব রোগের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে

ত্বকের সমস্যা: ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ, লক্ষণ: চুলকানি, লোম পড়া, ত্বক লাল হওয়া।

ঠান্ডা: সর্দি-কাশি ও ঠান্ডাজনিত রোগ, লক্ষণ: হাঁচি, নাক দিয়ে পানি পড়া, কাশি।

পায়ে সংক্রমণ: কাদা বা ভেজা স্থানে হাঁটায় পায়ে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ হতে পারে।

ডায়রিয়া ও হজমের সমস্যা: ভেজা বা দূষিত খাবার খেলে ডায়রিয়া হতে পারে।

ভাইরাল ফ্লু: বর্ষায় কুকুর-বিড়ালের মধ্যে ছোঁয়াচে ভাইরাস ছড়াতে দেখা যায়।

টিক ও ফ্লির আক্রমণ: ভেজা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে টিক ও ফ্লির সংখ্যা বেড়ে যায়, যা ত্বকের রোগ সৃষ্টি করে।

চিকিৎসা কোথায়

সরকারিভাবে কম খরচে চিকিৎসা নিতে হলে যেতে হবে পুরান ঢাকার বংশালে কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও পশুদের জন্য আলাদা সরকারি চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

এছাড়া ঢাকার মধ্যে ধানমন্ডি, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পোষা প্রাণীদের চিকিৎসার জন্য বেসরকারি পেট কেয়ার সেন্টার রয়েছে। ফ্রি সেবা দিতে কাজ করছে বেশ কিছু সংস্থাও।

দ্রুত ও সহজে পোষা প্রাণীর বিষয়ে যেকোনো পরামর্শ নিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে এ সম্পর্কিত পেজগুলো যাচাই করা যেতে পারে। কিছু পেইজে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকে।

জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা

বর্ষার সময় শুধু পোষা প্রাণীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাবার ও অসুখ-বিসুখ নিয়ে সতর্ক থাকলে হবে না, দুর্ঘটনাসহ যেকোনো জরুরি পরিস্থিতির জন্যও প্রস্তুত থাকা উচিত। ঘরে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক ওয়াইপসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখা উচিত।

এছাড়া, যেকোনো সময় যোগাযোগ করা যায় এমন পশু চিকিৎসকের ফোন নম্বর কাছে থাকা দরকার।

Comments

The Daily Star  | English

Govt publishes gazette of 1,558 injured July fighters

Of them, 210 have been enlisted in the critically injured "B" category, while the rest fall under the "C" category of injured fighters

6h ago