বাংলাদেশে আদিবাসী দিবসের গুরুত্ব

ছবি: পলাশ খান/স্টার

পৃথিবীর বুকে মানুষের আবির্ভাব কবে থেকে—এ নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। এ রহস্যে ঠাঁই পেয়েছে মানুষের আদিমতম অধিবাসী কারা? তাদের অধিকারই বা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর এতটা সহজ নয়। বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে তার সমাধানও অসম্ভব।

প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণায় অনুমাননির্ভর উপাত্ত থেকে এর সুরাহা দেওয়ার চেষ্টা আছে। বাংলাদেশের আদিবাসী নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ করলেও সরকারি তথ্যে তার অন্য অভিধা আছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে তাদেরকে আদিবাসী নামে অভিহিত করা হয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদার দিক থেকে এসব অধিবাসীরা অনেক পিছিয়ে। তাদের উন্নয়নে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। আদিবাসী দিবস এসব জাতিগোষ্ঠীর কাছে তেমন কোনো গুরুত্ববহন করে না।

আদিবাসীদের পরিচয় নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে। সর্বাধিক স্বীকৃত আদিবাসী সংজ্ঞা হলো, 'আদিবাসী শব্দের মূল বক্তব্য প্রান্তিকতায় যারা ঐতিহাসিকভাবে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে এবং এখনো প্রান্তিক অবস্থানে আছে। যারা আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়ে এবং এখনো নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। যাদের ভাষা, সংস্কৃতি বিলুপ্ত প্রায় এবং যারা সাধারণত রাজনৈতিকভাবে অন্যের অধীনস্থ। আদিবাসীদের অন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে যাদের সমাজ ব্যবস্থা, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দেশের মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি হতে পৃথক। যারা রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে প্রথাগত আইনের ভিত্তিতে সমাজ পরিচালনা ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি করে। ভূমির সঙ্গে যাদের নিবিড় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে এবং যারা সাধারণভাবে মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে তারাই আদিবাসী।'

আদিবাসী মানে হচ্ছে—মূলধারা থেকে যাদের ভাষা ভিন্ন এবং সংস্কৃতি ভিন্ন তাদেরকে আদিবাসী বলে। সে হিসেবে আমরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করছি।

উপরের বিবেচনায় বর্তমানে বিশ্বের ৭০টি দেশে ৩০ কোটির অধিক আদিবাসী বাস করে। কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় ৫২টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী (আমাটা, বামাগা, কয়েন প্রভৃতি) বা আদিবাসী বসবাস করছে। আমেরিকায় ক্রো জাতি, আর্জেন্টিনায় কাসি জাতি ইত্যাদিও এ পর্যায়ভুক্ত।

আদিবাসীরা অধিকাংশই এখনো মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অনেক দেশে আদিবাসীরা এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই পায়নি। বিশ্বব্যাপী আদিবাসী জনগণ সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার, অঞ্চল বা টেরিটরির অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতি লাভের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী-বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হয়। বাংলাদেশে দিবসটি পালন শুরু হয় ২০০১ সালে। সে বছর 'বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম' নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। ওই সংগঠনের মাধ্যমেই প্রতি বছর বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে বৃহৎ পরিসরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করা।

বাংলাদেশের প্রকৃতি আর আদিবাসী একে অপরের পরিপূরক। প্রকৃতি ছাড়া তাদের অস্তিত্ব কল্পনা করারও কোনো সুযোগ নেই। তাদের পরিবারে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পরপরই তার নিগূঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয় প্রকৃতির সঙ্গে। এ যেন হাজারও বছরের চিরাচরিত নিয়ম। তাদের চাষাবাদ, ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, ওষুধপত্র, খাবার-দাবার, জ্বালানিসহ সব কিছু সংগ্রহ করেন প্রকৃতি থেকে। বাংলাদেশ সরকারের তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ৫০ জাতের আদিবাসী রয়েছে।

বাংলাদেশের আদিবাসীকে প্রধানত চারটি ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এক. উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গাইবান্ধার আদিবাসী, যাদের অন্যতম হচ্ছে সাঁওতাল, ওরাং, মাহাতো, কোড়া, কাদর প্রভৃতি। দুই. বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণা অঞ্চলের গারো, কোচ, খাড়িয়া, বর্মণ ও ডালু প্রভৃতি আদিবাসী। তিন. সিলেট-মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জের আদিবাসী জৈয়ন্তা, মণিপুরী, খাসিয়া, হাজং, লালেং, পাত্র প্রভৃতি। চার. পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খুমি, খেয়াং, ম্রো, চাক, পাংখোয়া প্রভৃতি। নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠী আবার পটুয়াখালী ও কক্সবাজার জেলায় বসবাস করেন।

আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর জেলায় প্রায় ২০ লাখ আদিবাসীর বাস। এ অঞ্চলে প্রায় ৩০ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে। এদের মধ্য শিং, সাঁওতাল, ওরাঁও, মুন্ডারি, মাহতো, রাজোয়ার, কর্মকার, মাহালী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলায় রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী, যাদের অধিকাংশেরই জীবন-জীবিকার মূল উৎস পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ।

বাংলাদেশে সরকারের অবস্থান হচ্ছে—এখানকার মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি চার হাজার বছরের পুরোনো। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা সেটিই প্রমাণ করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া থেকে এসে বসতি স্থাপন করে। সেজন্য তারা এখানকার আদিবাসী নয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ ১৬ শতকে মিয়ানমার এবং কম্বোডিয়া থেকে আসা শুরু করে। সে জন্য তারা সেখানকার আদিবাসী নয় বলে সরকার মনে করছে। সরকারের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, আদিবাসী হতে হলে কলোনিয়াল কিংবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কলোনাইজেশন হতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেই ধরনের কিছুই হয়নি। অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় যাদের আদিবাসী বলা হয়, তাদের ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিস্থিতি হয়েছিল, বাংলাদেশে সে রকম কিছু হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের চেয়ে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও রীতি-নীতি আলাদা। এদিক থেকে বাংলাদেশের এই জনগোষ্ঠী নিজেদের আদিবাসী বলতে চান। তাদের দাবি, আদিবাসী বা উপজাতি শব্দগুলো বৈষম্য এবং বঞ্চনার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

২০১০ সালে ১২ এপ্রিল 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ২০১০' আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের ধারা ২(২) এ বলা হয়েছে, 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অর্থ তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও শ্রেণীর জনগণ।' একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে কোনো আদিবাসী নেই। আবার একই আইনে বলা হচ্ছে, আদিবাসীরাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। সংবিধানের ২৩(ক) এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

এখানেও বাঙালি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীদের, যারা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রাখে, তাদেরকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে রাষ্ট্র আখ্যায়িত করেছে।

অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, শিক্ষার অসচ্ছলতা, শিক্ষার অনগ্রসরতা, পেশাগত বৈচিত্র্যের অভাব, ভূমিহ্রাস, অসচেতনতা, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আদিবাসীদের পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ না করা, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন না করা ইত্যাদি বহুবিধ কারণে আদিবাসীদের উন্নয়ন আশানুরূপ নয়। তাই তাদের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারি, বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত আদিবাসী-বান্ধব উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিগত চার দশকেরও অধিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে সত্য, কিন্তু আদিবাসীদের স্বীকৃতি এবং অধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আদিবাসীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

দেশের আদিবাসীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে সামাজিক নানা খাতে বাংলাদেশে অগ্রগতি হলেও আদিবাসীদের মধ্যে তা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। দারিদ্র্যের হারও তাদের মধ্যে বেশি। তাদের উন্নয়নে বিচ্ছিন্ন কিছু কাজের বাইরে সরকারের সমন্বিত কোনো কর্মসূচি নেই। পিছিয়ে থাকাদের উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের উন্নয়নে সরকারের সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব আছে। তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার সঠিক চিত্রও জাতীয় পর্যায়ে নেই।

বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে প্রবাসী-আয়। প্রবাসী-কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে দেখা যায়, ৬৪টি জেলার মধ্যে গত এক দশকে সবচেয়ে কম বিদেশ গেছে এমন পাঁচটি জেলার মধ্যে প্রথমে রয়েছে বান্দরবান। এই তালিকায় আরও রয়েছে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি।

বাংলাদেশের আদিবাসীর উন্নয়নে নেওয়া কর্মসূচিতে যে সমন্বয়হীনতা আছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। টেকসই উন্নয়ন করতে হলে এসব জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণে আরও সচেষ্ট হতে হবে। অধিকাংশ আদিবাসীর ভাষা ও সংস্কৃতি বিপন্নের পথে। সংস্কৃতির কোনো উপাদান হারিয়ে যাওয়া মানে ওই সম্প্রদায়ের চিন্তা করার ক্ষমতাও ক্ষীণ হয়ে যাওয়া। স্বাধীন ও মত প্রকাশের মাধ্যমে তাদেরকে উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়াস। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা আদিবাসীর উন্নয়নে আরও সচেষ্ট হলে তাদের জীবনমান উন্নত হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তারা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবে—বিশ্ব আদিবাসী দিবসে এটাই তাদের প্রত্যাশা।

Comments

The Daily Star  | English

Investment slump deepens

Imports of capital machinery have fallen to multi-year lows, dipping even below Covid-19 levels

3h ago