গাজার ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দক্ষিণ সুদানে পাঠাতে চান নেতানিয়াহু

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি

গাজা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের পূর্ব আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ দক্ষিণ সুদানে তাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন ইসরায়েলি নেতা।

গতকাল বৃহস্পতিবার এই তথ্য জানিয়েছে সিএনএন।

ফিলিস্তিনিদের ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপের উদ্যোগ 

ইতোমধ্যে দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে ইসরায়েল। ২২ মাসের যুদ্ধে গাজার বেশিরভাগ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। পুরো অঞ্চলটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে মত দিয়েছেন নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন এমন ছয় সূত্র এপিকে এসব তথ্য সরবরাহ করেছেন। তবে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু জানা যায়নি।

বিশ্লেষকদের মত, এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে এক যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে আরেক যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে স্থানান্তরিত হবেন দুর্ভাগা ফিলিস্তিনিরা। এ যেন ফিলিস্তিনিদের ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপের উদ্যোগ।

সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই দেশটিতে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। পাশাপাশি, সুদানেও চলছে সরকারি সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনী আরএসএফের তাণ্ডব। সব মিলিয়ে, চরম অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে দক্ষিণ সুদান।

দক্ষিণ সুদানে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
দক্ষিণ সুদানে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

এতে নতুন করে গাজাবাসীদের মধ্যে অনাহার ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিবে এবং বড় আকারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি হবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চান—এমন দাবি করেছেন নেতানিয়াহু। এর আগে গাজাকে পর্যটন গন্তব্য, মধ্যপ্রাচ্যের 'রিভিয়েরা' হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন সাবেক আবাসন ব্যবসায়ী ট্রাম্প।

এ ক্ষেত্রে চটকদার ভাষা প্রয়োগ করেছেন ইসরায়েলি নেতা। তিনি বলছেন, গাজার বেশিরভাগ মানুষকে উন্নত জীবন দিতে 'ঐচ্ছিক অভিবাসনের' সুযোগ দেবেন তিনি। গাজাবাসীদের গ্রহণ করার জন্য আফ্রিকার কয়েকটি দেশকে ইতোমধ্যে প্রস্তাব দিয়েছেন নেতানিয়াহু।

মঙ্গলবার ইসরায়েলি টিভি চ্যানেল আই২৪কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেন, 'যুদ্ধ-বিগ্রহের যে রীতিনীতি আছে, সেটাকে বিবেচনায় রেখে আমার মত হলো, নিরীহ, বেসামরিক গাজাবাসীদের সরে যেতে দেওয়া উচিত। তারপর সেখানে থেকে যাওয়া শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালাতে হবে।'

ফিলিস্তিনিদের জোর খাঁটিয়ে গাজা থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফিলিস্তিনিরা, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং সার্বিকভাবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশগুলো ছাড়া বাকি সব দেশই এই উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে।

দক্ষিণ সুদানের জন্য এ ধরনের প্রস্তাব বড় সুফল বয়ে আনতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের অবিসংবাদিত ও সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রাথমিক ধাপ হতে পারে গাজাবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার উদ্যোগ। পাশাপাশি, এতে ভবিষ্যতে ট্রাম্প, তথা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পথও সুগম হতে পারে দেশটির জন্য।

ইসরায়েলের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যারেন হাসকেল দক্ষিণ সুদান সফর করতে ইতোমধ্যে রওনা হয়েছেন। এটাই ইসরায়েলের কোন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার দক্ষিণ সুদানে প্রথম সফর। তবে এই সফরে গাজাবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করার পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন হাসকেল।

দক্ষিণ সুদানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে আলোচনার খবরকে 'ভিত্তিহীন' বলে দাবি করেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জানান, তারা দুই দেশের গোপনীয় কূটনীতিক আলোচনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করে না।

মিশরের বিরোধিতা

দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে কাজ করছেন জো স্লাভিচ। তিনি একটি মার্কিন লবিইং প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জানান, তাকে দক্ষিণ সুদানের কর্মকর্তারা ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে ব্রিফিং দিয়েছেন।

তিনি জানান, শিগগির ইসরায়েল থেকে একটি প্রতিনিধিদল ফিলিস্তিনিদের জন্য শরণার্থী শিবির তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে দক্ষিণ সুদানে আসবে। তবে এখনো এই সফরের দিন-তারিখ সম্পর্কে জানা যায়নি।

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো জবাব দেয়নি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।

দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবায় সূর্যাস্তের সময়ের দৃশ্য। ফাইল ছবি: রয়টার্স
দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবায় সূর্যাস্তের সময়ের দৃশ্য। ফাইল ছবি: রয়টার্স

স্লাভিচ মত দেন, খুব সম্ভবত ইসরায়েলি অর্থায়নে এসব অস্থায়ী শিবির তৈরি করা হবে।

দক্ষিণ সুদানের নাগরিক সমাজ সংস্থার প্রধান এডমুন্ড ইয়াকানি জানান, তিনি দেশটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে গাজাবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় আরও চার কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে ইসরায়েল-দক্ষিণ সুদানের আলোচনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

মিশরের দুই কর্মকর্তা এপিকে জানান, ইসরায়েল বেশ কয়েক মাস ধরে গাজাবাসীদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি 'দেশ' খুঁজে ফিরছেন। দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে আলোচনা এই উদ্যোগেরই অংশ।

কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন, কায়রো ফিলিস্তিনিদের গ্রহণে রাজি না হওয়ার জন্য দক্ষিণ সুদানকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।

মিশরে গাজাবাসীদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে কায়রো। দেশটির আশঙ্কা, এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অসংখ্য শরণার্থী মিশরে ঢুকে পড়বে এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল অন্যান্য দেশের সঙ্গেও এ ধরনের আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে আছে সুদান, সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ড। ওই দেশগুলো যুদ্ধ ও ক্ষুধার আঘাতে জর্জরিত।

অর্থাভাবে জর্জরিত দক্ষিণ সুদান মিত্র খুঁজছে

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দক্ষিণ সুদানের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য স্লাভিককে নিয়োগ দিয়েছে দেশটি। তিনি জানান, ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবগত হলেও এতে ওয়াশিংটনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা নেই।

স্লাভিক বলেন, দক্ষিণ সুদান চায় ট্রাম্প প্রশাসন দেশটির বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করুক। ইতোমধ্যে দক্ষিণ সুদানের বেশ কয়েকজন 'অভিজাত' মানুষের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই বিধিনিষেধও তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেছে দেশটি। 

সাংবাদিক পিটার মার্টেল বলেন, 'অর্থাভাবে জর্জরিত দক্ষিণ সুদানের এমন একটি মিত্র প্রয়োজন, যে তাদেরকে আর্থিক ফায়দা ও কূটনীতিক সুরক্ষা এনে দিতে পারবে।'

ফিলিস্তিনিরাও দোটানায়

ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অনেকেই গাজার সংঘাতপূর্ণ এলাকা ছেড়ে যেতে আগ্রহী। তবে এই ইচ্ছে সাময়িক—ক্ষুধা ও যুদ্ধ এড়াতে সাময়িক ভাবে অন্য কোনো দেশে যেতে রাজি থাকলেও পাকাপাকিভাবে দক্ষিণ সুদানে যাওয়ার বিষয়ে তারা আগ্রহী নন।

তাদের আশঙ্কা, ইসরায়েলিরা আর কখনোই তাদেরকে মাতৃভূমিতে ফিরতে দেবে না। গণহারে তাদেরকে অন্য কোনো দেশে 'তাড়িয়ে' দিয়ে ইসরায়েল গাজাকে নিজ ভূখণ্ডের অংশ করে নেবে এবং সেখানে ইহুদিরা অবৈধভাবে বসতি তৈরি করবে। এ ধরনের পরিকল্পনার কথা ইসরায়েলি কট্টর ডানপন্থি মন্ত্রীরা প্রকাশ্যেই বলে থাকেন।

গাজা সিটির একটি শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি: রয়টার্স
গাজা সিটির একটি শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি: রয়টার্স

 আর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যারা গাজা ছাড়তে আগ্রহী, তাদেরও পছন্দের গন্তব্যের তালিকাতেও পৃথিবীর সবচেয়ে অস্থিতিশীল ও সংঘাতপূর্ণ দেশ দক্ষিণ সুদান নেই।

সুদানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধ চলছে। এই সংঘাতে চার লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং দেশটিতে বড় আকারে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, তেল সমৃদ্ধ দেশটির ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ পুরোপুরি আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন।

ট্রাম্প প্রশাসন বিদেশি সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমানোর পর দক্ষিণ সুদানের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

সুদান থেকে আলাদা হওয়ার দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতে  এক পক্ষে ছিল দক্ষিণ সুদানের খ্রিষ্টান ও অ্যানিমিস্ট ধর্মাবলম্বী আর অপর পক্ষে ছিল উত্তরের মুসলিম ও আরব প্রধান জনগোষ্ঠী।

এসব কারণে পরাজিত পক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে গাজাবাসীরা দক্ষিণ সুদানে এসে বৈরি পরিস্থিতিতে পড়বেন বলে মত দেন বিশ্লেষকরা। 

নাগরিক সমাজ সংস্থার প্রতিনিধি ইয়াকানি বলেন, 'কে আসছে আর কতদিনের জন্য আসছে, সেটা দক্ষিণ সুদানের মানুষদের জানা জরুরি।'

'মুসলিম ও আরবদের সঙ্গে ঐতিহাসিক শত্রুতার' কারণে ফিলিস্তিনিরা বিপাকে পড়তে পারেন বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, 'অন্য দেশ থেকে মানুষ এনে ফেলে দেওয়ার ভাগাড়ে পরিণত হোক দক্ষিণ সুদান, এমনটা কাম্য নয়। পাশাপাশি, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দরকষাকষিতেও এ বিষয়টি থাকা উচিত নয়।'

Comments

The Daily Star  | English
LDC graduation

Graduation or deferral: Is Bangladesh ready for the post-LDC era?

It now needs to be decided whether Bangladesh should actively pursue a deferral of LDC graduation.

6h ago