বিয়ের গীত: প্রান্তিক নারীর কণ্ঠে জীবনের সুর

ছবি: সংগৃহীত

আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা বাংলাদেশের একটি প্রান্তিক গ্রামে। লোকজ সংস্কৃতিতে ভরপুর ছিল সেই গ্রাম। বলা যায় লোকজ সংস্কৃতির ছায়া-স্পর্শেই আমার বেড়ে উঠা।

নিজ গ্রাম বা আশেপাশের গ্রামে কবে, কোথায়, কোন লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, তার খোঁজ রাখতাম এবং উপভোগ করতাম—কখনো বাবা-মাকে লুকিয়ে, আবার কখনো তাদের জানিয়েই।

জারি, সারি, পালাগান, পুঁথিপাঠ, যাত্রাপালা লেগেই থাকতো। বিশেষ করে পাড়া বা গ্রামের কারো বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হলে শুরু হতো বিয়ের গীতের আয়োজন।

পাত্র-পাত্রী দেখা থেকে শুরু করে গায়ে হলুদ, বর আগমন, কনের চলে যাওয়ার মতো বিভিন্ন পর্যায়ে গীত গাওয়া হতো প্রান্তিক অঞ্চলের বিয়ে উপলক্ষে। আমার বড় ভাই-বোনদের বিয়েতেও দেখেছি মা, চাচী, দাদী, ফুফুরা বিয়ের গীত গেয়েছেন, নেচেছেন।

আমাদের গ্রামের সেসময় তৃতীয় লিঙ্গের গীতের দল দেখেছি। তারা বিয়ে বাড়িতে গীত গাওয়ার বিনিময়ে টাকা, চাল, খাবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

গ্রাম ছেড়েছি ১৮-১৯ বছর বয়সে। কিন্তু বিয়ের গীত বা গ্রামের লোকজ সংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গ এখনো ছাড়তে পারিনি। সুযোগ পেলেই সেসব গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতি খুঁজে নেই, উপভোগ করি। বিশেষ করে বিয়ের গীতের প্রতি আমার অন্যরকম ভালো লাগা আছে। কারণ, শৈশবে মাকে বিয়ের গীত গাইতে ও নাচতে দেখেছি পরশীর বিয়ের উৎসবে।

বড় হতে থাকলাম; সমাজ বাস্তবতা বদলে যেতে লাগলো। মা এখন আর গীত গাইতে চান না। কিন্তু আমার এই ৩৪ বছর বয়সে বিয়ের গীতকে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছি। এই ভাবনায় গিয়ে মায়ের সেই গান ও নাচের স্মৃতি মনে পরে। এর অন্যতম কারণ আমার বোঝাপড়া।

লোকজ সংস্কৃতি নিয়ে আমার বোঝাপড়া বিয়ের গীত নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। আমি পেশাগত জায়গা থেকে বিয়ের গীত নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের আগ্রহী হই। ২০২০ সাল থেকে বিয়ের গীত নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়েছি। বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলছি। দেখতে পেয়েছি, বিয়ের গীত আমাদের গ্রামীণ জীবন থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে।

এই হারিয়ে যাওয়ার পেছনে আছে বৈশ্বিক সংস্কৃতির প্রভাব, নগরায়ন, গোঁড়া ধর্মীয় অনুশাসন। শৈশবে বিয়ের গীত সম্পর্কে তেমন জানাশোনা ছিল না। কিন্তু এখন বুঝি, গীত বাঙালি নারী সমাজের অনবদ্য সৃজনশীলতার স্বাক্ষর। বিয়ের গীত হলো বাঙালি লোকজ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা বিয়ের অনুষ্ঠানে নারীরা দলবদ্ধভাবে গেয়ে থাকেন। এটি সাধারণত ঢোল, করতাল, তালি ইত্যাদির সঙ্গে পরিবেশিত হয় এবং বর-কনের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক রীতি ও আবেগকে ঘিরে রচিত হয়।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যেখানে নারীর সাহিত্যিক বা শিল্পচর্চার সুযোগ সীমিত, সেখানে বিয়ের গীত হয়ে ওঠে নারীর অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও প্রতিবাদের এক অনন্য মাধ্যম। এই বিয়ের গীতের প্রচলন বাঙালি ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গেও জড়িত। গ্রামীণ প্রান্তিক নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সৃজনশীলতার সঙ্গে জড়িত।

গ্রামীণ নারীদের সৃজনশীলতার অন্যতম প্রমাণ এই বিয়ের গীত। এই বিপন্ন বা বিলুপ্তপ্রায় বিয়ের গীত নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ জরুরি। যে তথ্যচিত্র প্রজন্মান্তরে বিয়ের গীতের সমৃদ্ধ ইতিহাস পৌঁছে দেবে।

আমি মূলত ছড়িয়ে দিতে চাই বিয়ের গীতের সার্বিক বাস্তবতা। সেই লক্ষ্যে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকি। আমি আরও আগ্রহবোধ করি বিয়ের গীতের প্রতি। কারণ, বিয়ের গীত শুধু নাচ-গানের বিষয় নয়। এই বিয়ের গীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নারী জীবনের নানান পর্যায়—নারী জীবনের দুঃখ, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির গল্প—যা রচয়িতারা শব্দের বুননে গীতের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

বিয়ের উৎসবে বিয়ের গীত নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলে সাময়িকভাবে হলেও উৎসবমুখর হতে সহযোগিতা করে।

বিয়ের উৎসবে বিভিন্ন পর্যায়ের গীত আছে। যেমন—

আশীর্বাদ/মানত/আদ্যসূচনা পর্যায়ের গীত:

এই গীতগুলো বিয়ের আগের দিন বা সপ্তাহে গাওয়া হয়। গায়িকা কনে বা বর যেন সুখী হয় সেই কামনা করে গীত গায়। মানত পূরণ, পীর-ফকির, দেব-দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা ইত্যাদি থিম থাকে।

উদাহরণ: 'তুমি আসো ঘোড়ায় চইরা/ তোমার মুখে লক্ষ্মীর ছায়া…'

গায়ে হলুদের গীত:

বর ও কনের গায়ে হলুদের সময় গাওয়া হয়। আনন্দ, রং, রসিকতা ও কামনার ছোঁয়া থাকে। নারীরা দল বেঁধে এই গান গায় এবং রঙিন পরিবেশ তৈরি করে।

উদাহরণ: 'হলুদের বরণে আইলাম আমরা/ রাঙা পায়ে নূপুর বাঁধা…'

বিয়ে/বিবাহ/কন্যাদান পর্বের গীত:

বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের সময় গাওয়া হয়। আবেগঘন, উৎসবমুখর অথচ কিছুটা বিষাদের আবহও থাকে। বরের গুণগান, কনের প্রশংসা ও সংসারের কামনা উচ্চারিত হয়।

উদাহরণ: 'সোনার বরণ বর আইলো/ হীরার নাকফুল কিনাইলো…'

বিদায়ের গীত

কনের পিতৃগৃহ ত্যাগের মুহূর্তে গাওয়া হয়। গভীর বেদনা, মায়া ও চোখের জলের আবহে ভরা থাকে। মা–বাবা, ভাইবোন, প্রতিবেশীদের স্মৃতিচারণা থাকে।

উদাহরণ: 'মা গো আমি যাই পরবাসে/ চোখের জল থামে না…'

নতুন ঘরে আগমনের গীত

কনে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করলে গাওয়া হয়। শুভ কামনা, ভদ্রতা, ও নতুন জীবনের জন্য আশীর্বাদ থাকে। শাশুড়ি-বউয়ের কৌতুক মিশ্রিত গীতও প্রচলিত।

উদাহরণ: 'নতুন বউ ঘরে আইলো/ দীপ জ্বালো, ফুল ছড়াও…'

অনুষ্ঠানভিত্তিক নৃত্যগীত/প্রহসনের গীত:

এই পর্যায়ে হাস্যরসাত্মক, নৃত্যনির্ভর বা খোঁচা-মারধরভিত্তিক গান গাওয়া হয়। কখনও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও এই গানে অংশ নিয়ে আনন্দ পরিবেশ তৈরি করে।

উদাহরণ: 'বর আইলো খালি হাতে/ কই গেল রূপার আংটি…'

মূলত বিয়ে উৎসবের এই পর্যায়গুলো বাংলাদেশি নারী জীবনের নানান পর্যায়েরই প্রতিচ্ছবি। নারীর কণ্ঠে, নারীর নাচের মাধ্যমে নারী জীবনের এই পরিবেশনা পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির জীবনে আছে কি না, আমার জানা নেই।

নারী, মা, কন্যা, মেয়ের জীবনের এই নানা পর্যায়ের সঙ্গে লোকজ সংস্কৃতির যে সম্পর্ক, তা আমাকে তথ্যচিত্রটি নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। ২০২০ সাল থেকে বিয়ের গীত নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ প্রস্তুতি নিতে গিয়ে জেনেছি অঞ্চলভেদে বিয়ের গীতের রয়েছে বৈচিত্র্য। বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জা, বিয়ের গীতের ভিন্নতা, নাচের ভিন্নতা—সবমিলিয়েই বিয়ের গীত তথ্যচিত্র নির্মাণ করা গেলে তা বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশের নারী জীবনের সৃজনশীলতার প্রামাণিক দলিল হয়ে থাকবে।

আশায় বুক বেঁধে বিয়ের গীত নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য প্রতিনিয়ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে যাচ্ছি। প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চলের বিয়ের গীত শুনি। সেদিন বিয়ের গীত শুনতে শুনতে খেয়াল করলাম, মা গুনগুনিয়ে বিয়ের গীতের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন। সেই মুহূর্তে মনে পরলো, আমার ২৮-৩০ বছর বয়সী মায়ের স্মৃতি। পরশীর মেয়ের বিয়ে। আরও কয়েকজন পরশী নারীর সঙ্গে মা উঠোনে গীত গাইছেন আর নাচছেন।

আমি বিশ্বাস করি, এই বিয়ের গীত শুধু একটি গান নয়, এটি জনপদের স্মৃতি, নারী সমাজের সৃজনশীলতা ও বাংলাদেশের আত্মপরিচয়।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

How Dhaka’s rickshaw pullers bear a hidden health toll

At dawn, when Dhaka is just beginning to stir, thousands of rickshaw pullers set off on their daily grind.

17h ago