কমছে আবাদি জমি ও উৎপাদন, বাংলাদেশে গমের কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

বাংলাদেশে গমের বাজার
ফাইল ফটো

বাংলাদেশের কৃষক ধীরে ধীরে ভুট্টা, আলুসহ অন্যান্য উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হতে থাকায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গমের আবাদ নেমে এসেছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে এবং উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত শীত মৌসুমে ২ লাখ ৮ হাজার হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ৪১ হাজার টন গম ঘরে তুলেছেন কৃষক।

এবার নিয়ে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো গমের আবাদ কমেছে। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে গম আবাদ হয়েছিল ৮ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে—যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

এরপর থেকে কৃষক অধিক লাভজনক ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হতে থাকায় গমের আবাদি জমি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, আর কি কোনোদিন বিস্তৃত জমিতে আবাদ হবে গম?

কৃষিবিদরা বলছেন, কৃষকের গম উৎপাদনে আগ্রহ কমার পেছনে একাধিক কারণ আছে—শীতকালীন ভুট্টা, আলু ও অন্যান্য উচ্চমূল্যের সবজির তুলনায় কম লাভ, উন্নত জাতের অভাব, ২০১৬ সালে গম ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব, শীত মৌসুম ছোট হয়ে আসা ইত্যাদি।

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিডব্লিউএমআরআই) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ রেজাউল কবীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভুট্টা প্রায় নগদ ফসলে পরিণত হয়েছে। আগে যেসব জমিতে গম চাষ হতো, এখন সেখানে ভুট্টা হচ্ছে।'

কৃষি-বিজ্ঞানীরা জানান, গমের চেয়ে ভুট্টার বেশি ফলন হয়, মুনাফাও বেশি হয়। প্রতি হেক্টরে ১১-১২ টন ভুট্টা পান কৃষক, যা গমের প্রায় তিনগুণ। পাশাপাশি পোল্ট্রি, মাছ ও গবাদিপশুর খাদ্যের চাহিদার কারণে কৃষক ভালো দামও পান ভুট্টার।

রেজাউল বলেন, 'ফসল চক্র ও আবহাওয়ার উপযোগিতার কারণেই এখন কিছু এলাকায় গম চাষ হচ্ছে।'

গত মার্চের শেষ দিকে প্রকাশিত গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেটে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) জানিয়েছে, আবহাওয়ার পরিবর্তন গম উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এতে বলা হয়, 'বাংলাদেশে শীত মৌসুম ছোট হচ্ছে এবং শীতকালে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকছে।'

গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক একেএম আমিনুল ইসলাম বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতকাল ছোট হয়ে আসছে।

কৃষক সাধারণত ডিসেম্বরে গম আবাদ করেন। এরপর ফুল ধরার সময় তাপমাত্রা বেড়ে যায়, ফলন কমে যায়। এ কারণে কৃষক আর লাভ করতে পারে না।'

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে বাংলাদেশে বার্ষিক গড় গম উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ টন।

ইউএসডিএর প্রতিবেদন বলেছে, গম ব্লাস্ট রোগ এই ফসলের ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয় এবং এটাই উৎপাদন কমতে থাকার অন্যতম কারণ।

বিডব্লিউএমআরআই বিজ্ঞানীরা বলেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ব্লাস্ট-প্রতিরোধী জাত বারি গম-৩৩ উদ্ভাবন করেছে।

বর্তমানে গমের মোট আবাদি জমির এক-তৃতীয়াংশের বেশি জায়গায় এই জাতের গম চাষ হচ্ছে উল্লেখ্য করে রেজাউল কবীর বলেন, 'এটা ব্লাস্ট-প্রতিরোধী জাত। এ কারণে কৃষক পছন্দ করছেন। বারি গম-৩২ জাতও ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে।'

বিডব্লিউএমআরআইয়ের পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) আব্দুল হাকিম, আধুনিক জাত বিডব্লিউএমআরআই গম-৫-এর ফলন সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা সহায়তায় হাইব্রিড গমের বীজ উন্নয়নে কাজ শুরু করেছি। আমরা বেশি ফলনশীল উন্নত জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চালাচ্ছি।'

প্রধান সমস্যাগুলোর একটি হলো দামের অনিশ্চয়তা এবং আমদানিকৃত গমের কম মূল্যের কারণে কৃষকদের ক্ষতির ঝুঁকি।

বাংলাদেশে গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় ব্যবহারের জন্য প্রতিবছর প্রায় ৭৫ লাখ টন গম লাগে এবং এর অধিকাংশই মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমে।

হাকিম আরও বলেন, স্থানীয় কৃষকরা যখন গম কাটেন, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচুর গম পাওয়া যায়। এ কারণে আমদানি করা গম স্থানীয় গমের দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এটাই কৃষকদের ভুট্টা চাষের দিকে ঝোঁকার অন্যতম কারণ।'

কোনো সম্ভাবনা?

গম চাষে সম্ভাবনা অবশ্যই আছে বলে মনে করেন হাকিম।

সাম্প্রতিক সময়ে ভুট্টায় রোগের আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া ভুট্টা চাষের কারণে মাটির মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা ক্ষুদ্র পুষ্টকণা কমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।

বিডব্লিউএমআরআইয়ের এই সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় পানির সংকটের কারণে গম চাষ সেখানে বাড়ছে।

বিডব্লিউএমআরআই একটি লবণাক্ততা-সহনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে (বিডব্লিউএমআরআই গম-৪), যার এক হেক্টরে ফলন সম্ভাবনা সাড়ে ৫ টন।

তিনি বলেন, 'দক্ষিণাঞ্চলে আমন কাটার পর হাজার হাজার হেক্টর জমি পড়ে থাকে। তাই সেখানে গম চাষ বাড়ানো যেতে পারে।'

'আমরা সেখানে বীজ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছি। যদি দক্ষিণাঞ্চলের ২ লাখ হেক্টর জমি গমের আওতায় আনা যায়, তবে মোট উৎপাদন বাড়বে। এভাবে উৎপাদন ২০ লাখ টনে পৌঁছাবে', যোগ করেন হাকিম।

Comments

The Daily Star  | English

Logistics not yet ready for post-LDC graduation needs

Lack of efficient logistics poses threat to Bangladesh's export competitiveness, speakers say

16h ago