ডিভোর্সের পর সন্তানের দায়িত্ব কার, আইন কী বলে

বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সর্ম্পকের ইতি ঘটলেও পরিবারের সন্তানের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। বাবা-মা দুজনই সন্তানকে কাছে রাখতে চান। আবার অনেকক্ষেত্রে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবসানের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে সন্তানের ওপর। পরিবারে ভাঙন ও নতুন বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এ কারণে ডিভোর্সের পর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সন্তানের দায়িত্ব এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা।
ডিভোর্সের পর সন্তানের দায়িত্ব কার—সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা।
আইন কী বলে
আইনজীবী সারওয়াত সিরাজ শুক্লা বলেন, 'ডিভোর্সের পর প্রায়ই দেখা যায় বাবা-মা দুজনেই সন্তানের কাস্টডি বা হেফাজত দাবি করছেন। সন্তানের অভিভাবকত্ব ঘিরে তিক্ত ও বিলম্বিত আইনি যুদ্ধও তৈরি হয়।'
তিনি জানান, বাংলাদেশে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্ব মূলত ৩টি আইন দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে।
এগুলো হলো—মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) প্রয়োগ আইন ১৯৩৭, অভিভাবকত্ব ও নাবালক আইন ১৮৯০ এবং পারিবারিক আদালত অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫।
মুসলিম ব্যক্তিগত আইন ১৯৩৭ এর ২ ধারা অনুসারে, মুসলমানদের ব্যক্তিগত বিষয়, যেমন, বিয়ে, তালাক, সন্তানের কাস্টডি বা হেফাজত এবং উত্তরাধিকার ইত্যাদি ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
'মনে রাখতে হবে, মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী সন্তানের হেফাজত এবং অভিভাবকত্ব দুটি আলাদা বিষয়,' বলেন এই আইনজীবী।
তার মতে, কাস্টডির ক্ষেত্রে সন্তানের ছোট বয়সে মা সাধারণত অগ্রাধিকার পান। এখানে সন্তানের বয়সসীমা ও অধিকার নির্ধারণে ইসলামিক ফিকহ (হানাফি মাযহাব ইত্যাদি) অনুসরণ করা হয়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিম সুন্নি ও হানাফি মাযহাবের অনুসারী। এই মাযহাব মতে, ছেলের হেফাজত ৭ বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়ের হেফাজত বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের। ছোট বয়সে শিশুর হেফাজত মূলত মায়ের কাছে থাকে।
ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা বলেন, 'সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো অভিভাবকত্ব ও নাবালক আইন ১৮৯০। এটি কাস্টডি বা অভিভাবকত্ব বিষয়ে মূল প্রক্রিয়াগত আইন।'
এই আইনের ৭ নম্বর ধারা বলছে, আদালত অভিভাবক নিয়োগ বা ঘোষণা করতে পারেন।
ধারা ১৭ অনুযায়ী, অভিভাবক নিয়োগ বা সন্তানের হেফাজত বা কাস্টডি দেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আদালতের প্রধান বিবেচ্য বিষয় সন্তানের কল্যাণ।
এই আইন অনুসারে পিতা জীবিত ও যোগ্য হলে সাধারণত অন্য কাউকে অভিভাবক করা হয় না। অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে আইনি ও আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার, যা সাধারণত পিতার কাছে থাকে। তবে আদালত বর্তমানে ক্ষেত্র বিশেষে এই নিয়ম থেকে সরে আসতে শুরু করেছে।
'যদি পিতা-মাতার মধ্যে বিবাদ হয় বা একজন অভিভাবক অযোগ্য প্রমাণিত হন, তাহলে আদালত সন্তানের কল্যাণ (ওয়েলফেয়ার অব দ্য চাইল্ড) নীতিকে সর্বাগ্রে রেখে সিদ্ধান্ত নেবে,' বলেন ব্যারিস্টার শুক্লা।
তিনি জানান, আদালত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত সন্তানের বয়স, সন্তান ছেলে না মেয়ে, অভিভাবকের নৈতিক চরিত্র, আর্থিক সামর্থ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পুনর্বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করে থাকে।
এছাড়া, সন্তানের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে লক্ষ্য রেখে আদালত সিদ্ধান্তে পৌঁছান।
'এক্ষেত্রে আদালত সন্তানের মতামত যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে খাস কামরায় জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমেও সন্তানের মতামত গ্রহণ করা হয়,' বলেন এই আইনজীবী।
Comments