‘৬০ লাখ যথেষ্ট নয়’

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার মিনিয়াপোলিসের অ্যানানসিয়েশন গির্জার বাইরে একটি রাইফেল, শটগান ও পিস্তল নিয়ে অবস্থান নেন রবিন ওয়েস্টম্যান (২৩)। ওই ক্যাথলিক গির্জার ভেতরে আছে স্কুল। আচমকা গির্জার কাঁচের জানালা দিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন তিনি।
বিবিসি জানিয়েছে, গতকাল বুধবারের ওই ঘটনায় দুই শিশু নিহত হয়েছে। একজনের বয়স আট ও অপরজনের বয়স ১০ বছর। আহত হয়েছে ১৪ শিশুসহ মোট ১৭ জন।
কেন এমন হত্যাযজ্ঞে নামলেন রবিন, বিষয়টি নিয়ে জল্পনা চলছে। এর মধ্যে আগুনে ঘি ঢেলেছে হামলার আগে রবিনের পোস্ট করা দুই ভিডিও।

ইউটিউবের ওই ভিডিওগুলো ইতোমধ্যে সরিয়ে ফেলা হলেও সেখান থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট ও অন্যান্য তথ্য থেকে হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু ধারণা পাওয়া গেছে।
গির্জায় হামলার পেছনে ইহুদিবিদ্বেষ?
ইসরায়েলপন্থি সংগঠন অ্যান্টি ডিফেমেশন লিগের (এডিএল) বরাত দিয়ে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, ক্যাথলিক স্কুলে হামলা চালানোর আগে বন্দুকধারী ইউটিউবে দুইটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন। সেসব ভিডিওতে 'ইহুদিবিদ্বেষ' ও 'ইসরায়েল-বিরোধী' বার্তা ছিল।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে ওই ভিডিওগুলোকে রবিনের 'ইশতেহার' বলা হয়েছে।

হামলার অল্প সময় আগে আপলোড করা ওই দুই ভিডিওতে রবিন আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলির ম্যাগাজিন দেখান। সেগুলোয় সাদা কালিতে কিছু বার্তা লেখা ছিল।
ভিডিওতে দেখা যায়, অস্ত্রের গায়ে 'ইসরায়েল ধ্বংস করুন' ও 'এইচআইএএস ধ্বংস করুন' লেখা। এইচআইএএস একটি ইহুদিভিত্তিক শরণার্থী সংস্থা।
এই সংগঠনের কার্যক্রমকে প্রায়ই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা (হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট) 'মহা প্রতিস্থাপন তত্ত্বের' প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে।
ভয়েস অব আমেরিকার ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন মতে, 'গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট থিওরি' নামে পরিচিত তত্ত্বে যারা বিশ্বাস করেন তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য দেশ থেকে অশ্বেতাঙ্গদের নিয়ে আসা হচ্ছে এবং এই উদ্যোগের সঙ্গে ইহুদিদের যোগসূত্র রয়েছে।
রবিনের দেখানো একটি আগ্নেয়াস্ত্রের হাতলে 'রবার্ট বাওয়ার্স' লেখা ছিল। ওই ব্যক্তি (রবার্ট) ২০১৮ সালে পেনসিলভেনিয়ার পিটসবার্গে ট্রি অব লাইফ সিনাগগে ১১ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেন। তিনি একজন স্বঘোষিত শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী।
হত্যাকাণ্ডের আগে বাওয়ার্স অনলাইনে এইচআইএসের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছিলেন।

তবে এর মধ্যে সবচেয়ে রহস্যজনক বার্তাটি হলো '৬০ লাখ যথেষ্ট নয়', যা অপর এক অস্ত্রে লেখা ছিল।
এটি ইহুদি নিধনের সবচেয়ে বড় ও মর্মান্তিক ঘটনা হলোকাস্টের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন জার্মান শাসক হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নেতৃত্বে ব্যাপক ইহুদি নিধনের ঘটনা ঘটে যা হলোকাস্ট নামে পরিচিত। হলোকাস্টে মোট নিহতের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংখ্যাটি ষাট লাখ।
স্মোক গ্রেনেড সদৃশ একটি বস্তুর গায়ে 'ইহুদি গ্যাস' লেখা ছিল।
তবে এখনো তদন্তকারীরা হামলার কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয়নি।
যেভাবে হামলা হয়
হামলা চালানোর জন্য রবিন ওয়েস্টম্যান গির্জার এক পাশে অবস্থান নেন। গির্জার জানালা দিয়ে তিনি বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। তিনি রাইফেল, শটগান ও পিস্তল ব্যবহার করেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি স্মোক বম্বও উদ্ধার করে। সম্ভবত এসব অস্ত্রই তিনি ভিডিওতে দেখিয়েছিলেন।

হামলার সময় গণপ্রার্থণায় প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও অংশ নিয়েছিল।
পুলিশি তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে, গির্জার বাইরে থেকেই গুলি চালানো হয়েছিল।
কে এই রবিন ওয়েস্টম্যান?
যে বিদ্যালয়ের গুলি চালিয়েছেন রবিন সেই বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী তিনি। ২০১৭ সালে সেখান থেকে পাস করেছিলেন। তিনি নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচয় দিতেন।
রবিনের মা মেরি গ্রেস ওয়েস্টম্যান ওই স্কুলেই কাজ করতেন। ফেসবুক পোস্টের তথ্য অনুসারে, তিনি ২০২১ সালে অবসর নেন।
আগে থেকে শিডিউল করে রাখা একটি অনলাইন পোস্ট সম্পর্কে পুলিশ জানতে পেরেছে। হামলার সময় এটি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তবে তদন্তকারীরা ওই পোস্ট মুছে দিয়েছেন।

২০২০ সালে রবার্ট থেকে নিজের নাম বদলে রবিন করে নেন তিনি। মিনেসোটা আদালতের রেকর্ড মতে, আবেদনপত্রের মন্তব্যে বিচারক লেখেন, 'একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু নিজেকে নারী হিসেবে পরিচয় দিতে চায়। সে অনুযায়ী নিজের নাম বদলের আবেদন করেছে।'
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে মিনিয়াপোলিসের মেয়র জ্যাকব ফ্রে এই হামলাকে ঘিরে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশের বিরোধিতা করেন।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সচিব ক্রিস্টি নোয়েম এক্স পোস্টে উল্লেখ করেন, ওয়েস্টম্যান 'পুরুষ হলেও নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে দাবি করতেন'। এফবিআই পরিচালক ক্যাশ পাটেল তার পোস্টে রবিনকে 'পুরুষ' বলে আখ্যা দেন।
হামলার প্রতিক্রিয়া ও তদন্ত কার্যক্রম
প্রথম মার্কিন পোপ চতুর্দশ লিও নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করেছেন।
পুলিশ প্রধান ব্রায়ান ও'হারা গণমাধ্যমকে বলেন, 'নিষ্পাপ শিশু ও প্রার্থনারত মানুষদের ওপর জেনেবুঝেই এই সহিংসতা চালানো হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'গির্জার ভেতর অনেক শিশু আছে, এটা জেনেও সেখানে গুলি চালানোর মধ্যে যে নির্মমতা ও কাপুরুষতা রয়েছে, এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না।'

প্যাটেলের মন্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, মিনিয়াপোলিস পুলিশ বিভাগ এই তদন্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদেরকে সহায়তা করছে এফবিআইসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থা। তথ্যপ্রমাণ অনুসরণ করে তদন্তকাজ এগিয়ে চলবে।
মিনেসোটা গভর্নর টিম ওয়ালজ জানান, এই ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার দল 'গভীর সমবেদনা' জানিয়েছে এবং সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

ট্রাম্প পরবর্তীতে জানান, নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হোয়াইট হাউসে মার্কিন পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
Comments