দক্ষিণ সীমান্তে বাড়তি অনিশ্চয়তা

রয়টার্স ফাইল ছবি

আরাকান থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পূর্তি হয়ে গেল গত মাসে। এর মাঝে দেশে একটা সরকার গেল, নতুন সরকার এলো। এই সমস্যা নিয়ে বহু সম্মেলনও হলো ঘরে-বাইরে। কিন্তু আরাকানি মুসলমানদের ফেরত পাঠানো যায়নি, বরং তাদের আগমন অব্যাহত আছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশ তার রোহিঙ্গা নীতি-কৌশল নিয়ে পুনর্ভাবনা করবে কি না?

অসত্য আশাবাদের পরম্পরা

বিগত সরকারের মতো বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পরও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে অনেক অসত্য আশাবাদ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়। অনেকের মনে থাকার কথা, ২০২৩ সালের এপ্রিলে কুনমিংয়ে বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমারের মাঝে ত্রিপক্ষীয় এক বৈঠক হয় এ বিষয়ে। তখন শেখ হাসিনা সরকার জানিয়েছিল বছর শেষ হওয়ার আগেই পরীক্ষামূলকভাবে সাত হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে ফেরত নিবে নেপিডো সরকার। কার্যত তা হয়নি।

তারও আগে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার একই বিষয়ে একটা চুক্তি করার পর সীমান্ত ফেরিয়ে ঢুকে পড়া আট লাখ মানুষের তালিকা হস্তান্তর করা হয়। তার মধ্য থেকে মিয়ানমার মাত্র ৭ শতাংশ সম্পর্কে 'ক্লিয়ারেন্স' দেয় জানা গেলেও বাস্তবে একজনকেও নেওয়া হয়নি।

এবছর এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন নীতিনির্ধারক জানিয়েছিলেন, এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া হবে। তারা মিয়ানমার কর্তৃক 'ভেরিফায়েড'। 'এমনকি সংখ্যাটা আরও বাড়তেও পারে' বলেও উল্লেখ করা হয়। এই আশাবাদকে ভিত্তি করে সরকার সমর্থক নবীন একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ফেসবুকে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। বাস্তবে কী হলো সেটা সবার জানা।

গত মার্চেও বলা হয়েছে রোহিঙ্গারা আগামী রমজানে আরাকানে থাকবে। এখন আবার এ বছরের রোহিঙ্গা বিষয়ক সম্মেলনগুলোকে ঘিরে আরেক দফা আশাবাদ ছড়ানো হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্যোগ ইতিবাচক

ইতোমধ্যে আগস্টে কক্সবাজারে একটা সম্মেলন হলো। সেপ্টেম্বরে হবে নিউইয়র্কে এবং তারপর হবে কাতারের দোহায়। এই সম্মেলনগুলোর অন্তত দুটো ইতিবাচক ফল আছে। প্রথমত, রোহিঙ্গা সমস্যা কিছুটা হলেও আবার আন্তর্জাতিক মনোযোগে ফিরছে বা ফিরবে। দ্বিতীয়ত রোহিঙ্গা শিবির চালানোর খরচপাতিও কিছু পাওয়া যাবে।

ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধের মাঝে আরাকানিজ এই মুসলমানদের দুঃখ, কষ্ট ও মাতৃভূমি থেকে উৎখাতের বিষয়ে মনোযোগ বেশ কমে গিয়েছে। নিশ্চয়ই সেটা ফিরিয়ে আনবে এসব সম্মেলন। আবার রোহিঙ্গা শিবির পরিচালনায় তহবিল যেভাবে কমছে সেটা বাংলাদেশের জন্য বড় এক উদ্বেগের বিষয়। পরপর তিনটা সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আর্থিক এই সংকট সম্পর্কেও আন্তর্জাতিক সমাজকে অবহিত করতে পারবে। এগুলোও জরুরি কাজ। কিন্তু এসব সম্মেলন রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার রাস্তা তৈরি করবে কি না, সেটা অনিশ্চিত। কারণ রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শর্তের উপর। সেই বিবেচনায় বলতে হয়, আরাকানে বরং এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা রোহিঙ্গাদের ফেরত যেয়ে শান্তিপূর্ণ বসবাসের পক্ষে ধারণা দেয় না।

যেমন, এ মুহূর্তে নাটকীয়ভাবে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে আরাকান আর্মির গেরিলাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এর আগে কিছু রোহিঙ্গাকে দেখা গেছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর হয়ে আরাকান আর্মির বিপক্ষে লড়তে। এই দুই ধারার ঘটনাবলী নিশ্চিতভাবে রাখাইনদের সঙ্গে আরাকানিজ মুসলিমদের সম্পর্কে বৈরিতা বাড়াবে।

অনেকে বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হলে তাদের সেখানে জাতিগত স্বীকৃতি ও নাগরিক অধিকার দিতে হবে। মিয়ানমারে জাতিসত্তাগুলোর তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেই কারণে তারা দেশটির নাগরিক আইনেও বঞ্চনার শিকার। আবার, এই দুই বিষয়ে মিয়ানমার সরকার ইতিবাচক সংস্কার উদ্যোগ নিলেও রোহিঙ্গাদের আরাকানে পৌঁছা সহজ হবে না—যতক্ষণ না আরাকান আর্মি এবং স্থানীয় রাখাইনরা তাদের ব্যাপারে সদয় হয়।

যেহেতু ২০১৭ ও ২০২৫ সালের মাঝে আরাকানের পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে, সে কারণে এখন আর মিয়ানমার সরকার চাইলেই রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া সম্ভব নয়। বরং ফেরত যাওয়ার জন্য আরাকানের স্থানীয় পরিস্থিতি ও পরিবেশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি বাংলাদেশ থেকে বস্তুগত কিছু লাভের বিনিময়ে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের নিতে রাজি হলেও স্থানীয় রাখাইন সমাজের সঙ্গে মিলে-মিশে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে থাকার অবস্থা না থাকলে আবারও রোহিঙ্গাদের ফেরতই আসতে হবে। ১৯৭৮-৭৯ থেকে বারবার সেটাই ঘটছে।

এরকম ইতিহাসের মাঝে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন গেরিলাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের এখনকার যুদ্ধভঙ্গী আরাকানজুড়ে সামাজিক পরিবেশ উন্নত করতে কতটা সহায়ক, সেটা নির্মোহভাবে ভেবে দেখা দরকার। রোহিঙ্গা-নেতৃত্ব যদি মনে করে যুদ্ধ করেই তারা আরাকানে মর্যাদার সঙ্গে থাকার অধিকার আদায় করে নিবেন, তাহলে বাংলাদেশকেও ভিন্ন এক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তখন আরাকান আর্মির অসন্তোষের মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকেও। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা আরও জটিল চেহারা নেবে এবং আরাকান আর্মি স্বাভাবিকভাবে চারিদিকে এমন বন্ধু খুঁজবে এবং এমন সব আচরণ করবে যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারও সম্ভবত এই ধরনের পরিস্থিতি চাইছে। সেক্ষেত্রে তারা পুরোনো পাপের অনেকখানি আড়াল করতে পারবে।

দক্ষিণ সীমান্তে সম্পূর্ণ নতুন বাস্তবতা

দক্ষিণ সীমান্তে বাংলাদেশের জন্য একটা দুর্ভাগ্যের দিক হলো রোহিঙ্গা সমস্যা দ্বারা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক একচেটিয়াভাবে প্রভাবিত থাকার কারণে আকিয়াব, রেঙ্গুন বা নেপিডো কোথাও অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে এগোতে পারেনি ঢাকার কর্মকর্তারা। অথচ এই তিন দিকেই বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি ছিল। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত না করে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবরই ইউরোপ-আমেরিকার প্রতি বেশি মনযোগী। কিন্তু বাস্তবে বাঁচতে হবে আমাদের সীমান্ত সংলগ্নদের সঙ্গেই। আরাকানে ১৭টি টাউনশিপের (বাংলাদেশের জেলা সমতুল্য) মধ্যে আরাকান আর্মি ১৪টি দখল করে নিয়েছে। বাকি ৩টিও তাদের ঘেরাওয়ে রয়েছে, যেকোনো সময় তাদের হাতে আসবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য আরাকানের এই পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। যেকোনো সময় ৩০-৩৫ বর্গকিলোমিটারের আরাকানের পুরো নিয়ন্ত্রণ যাবে আরাকান আর্মির কাছে। এটা এমন এক নতুন পরিস্থিতি যা বাংলাদেশের জন্য দক্ষিণ সীমান্তের অতীত বিবেচনাগুলো পাল্টানোর তাগিদ দিচ্ছে। এরকম অবস্থায় বাংলাদেশের যেমন পুরোনো রোহিঙ্গানীতি পর্যালোচনা করা অপরিহার্য, তেমনি রোহিঙ্গা বিষয়কে ভিন্ন টেবিলে রেখে হলেও কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক লাভা-লাভের মূল্যায়ন করতে হবে।

আবার আগামী ডিসেম্বরের পর মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও ভিন্ন চেহারা নেবে। সামরিক জান্তা জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গায়ে একটা বেসামরিক লেবাস লাগিয়ে নিতে পারলে রোহিঙ্গা বিষয়ে এখনকার ছদ্ম নমনীয় মনোভাব বদলে ফেলতে পারবে তারা। এখন নির্বাচনের পক্ষে বিশ্বজনমতকে ইতিবাচক রাখতে তারা রোহিঙ্গা বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মনোভাব দেখাচ্ছে—যদিও প্রকৃত কোনো নীতিগত বা সামরিক ছাড় দেয়নি। তবে এসময় বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোর মাধ্যমে সামরিক জান্তার কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি আদায় করতে পারে, সেটা এই সমস্যা সমাধানে এক ধাপ অগ্রগতি হতে পারে। যেহেতু উত্তর আরাকানে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরে আসা রাখাইনদের বিরুদ্ধে লড়াইরত সামরিক জান্তার জন্য কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক ব্যাপার হবে, সেকারণে তারা এ বিষয়ে সম্মত হতেও পারে। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের জাতিগত স্বীকৃতি না দিয়েও জান্তা নাগরিক অধিকারের বিষয়ে ছাড় দিতে পারে চাইলে। এরকম কিছু ঘটলে আরাকান আর্মিকেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ যৌক্তিকভাবে চাপ দিতে পারবে।

চীন-ভারত ঘনিষ্ঠতা নতুন উপাদান হিসেবে হাজির হলো

আরাকান বিষয়ে বাংলাদেশকে চীনের সহযোগিতা পাওয়া ও নেওয়াও বিশেষ দরকার। আরকান আর্মি ও নেপিডো সরকার উভয়ের ওপর বেইজিংয়ের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিষয়ে পশ্চিমাদের গত আট বছরের যাবতীয় পরামর্শ অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশ এ কাজে চীনের কাছে সাহায্য চাইবে কি না বা চীনকে রাজি করাতে সক্ষম হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের ওপর। নিশ্চয়ই সেরকম কিছুর জন্য বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইবে চীন। আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিস্তা প্রকল্পের আলোচনাকালেও বিষয়টি উত্থাপন করতে পারে।

ইতিহাসের ঠিক এসময়ে চীন ও ভারতের মাঝে সম্পর্ক যে মধুর চেহারা নিচ্ছে, সেটাও বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য একটা সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করছে। চীনের পাশাপাশি আরাকানে ভারতেরও বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে এই দুই দেশ যৌথভাবে আরাকানে স্থিতিশীলতা চাইবে। কোনোভাবেই তারা আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ দেখতে চাইবে না। বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো চীন ও ভারতকে দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মিকে প্রভাবিত করা। এ কাজ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের চেয়েও বেশি কার্যকরভাবে হতে পারে বাংলাদেশের একার শক্তিতে। আসন্ন দুই সম্মেলন এক্ষেত্রে একটা সুবিধাজনক আবহাওয়া তৈরি করতে পারে কেবল। সম্মেলনগুলো যদি রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে চীনবিরোধ কোনো ভঙ্গী নেয়, সেটা আবার বাংলাদেশের জন্য জটিল অবস্থা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা ইস্যু যেন কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্র-চীন ঠান্ডাযুদ্ধের অংশ না হয়ে পড়ে, সে বিষয় খেয়াল রাখার দায় আছে বাংলাদেশের।

আবার ক্যাম্পের খরচপাতির ৭০ ভাগ যেহেতু পরোক্ষভাবে ইউরোপ-আমেরিকার তরফ থেকে আসে, সেটা ডিসেম্বরের পরও অব্যাহত না থাকার বিপজ্জনক এক শঙ্কাও এখন বাংলাদেশের সামনে। ওই 'দাতা'দের জন্যও বাংলাদেশকে চাপে ফেলে কিছু আদায় করার এটা মোক্ষ মুহূর্ত। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মতোই দক্ষিণ সীমান্তেও আসন্ন সময়টা অনিশ্চয়তায় ভরা।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

The Daily Star  | English
Election in Bangladesh

Why are we trying to make the election uncertain?

Those who are working to prevent the election should question themselves as to how the people will be empowered without one.

12h ago