বিএনপি নেতারা মেয়র থাকার অযোগ্য!
গাজীপুরের মেয়র এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, হত্যা চেষ্টা, মোবাইল ফোন ছিনতাইসহ নানান অপকর্মের দায়ে তিনি অভিযুক্ত বলে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোটারদের জন্য কারও আফসোস হতেই পারে, যারা এমন একজন ব্যক্তিকে ২০১৩ সালে বিপুল ভোটে মেয়র পদে জয়ী করেছিলেন। ভোটের সময় হয়ত তাঁরা না বুঝেই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের সৌভাগ্য বলতে হয়! সরকার এমন ব্যবস্থা করেছে যে, এমন একজন মেয়রের কাছ থেকে তাদেরকে দীর্ঘ দিন নাগরিক সেবা পেতে হয়নি।
গত চার বছরে মাত্র ১৮ মাস মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন মান্নান। ২২ মাসের বেশি সময় তাঁকে জেলে কাটাতে হয়েছে; তাঁর অনুপস্থিতে অন্যজন মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি সময় জেলের বাইরে থাকলেও মেয়রের চেয়ারে বসার সুযোগ পাননি। মেয়র হিসেবে তাঁর মেয়াদ আছে আর মাত্র ১৩ মাস। এ পরিস্থিতিতে ৬ জুলাই তৃতীয় বারের মত মেয়র পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। আইনি লড়াইয়ে জিতে ফিরতে ফিরতে তাঁর মেয়াদ থাকবে কিনা বলা মুশকিল। না ফিরলে গাজীপুরবাসীকে এমন একজন নগর পিতার জন্য আফসোস করতেও হবে না।
আরও পড়ুন: রাজনীতিতে ফখরুল অচল!
মান্নানকে মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়ায় নিন্দুকেরা সরকারের সমালোচনা করেছেন। এ জন্য তাঁরা শুধু নেতিবাচক দিকগুলোকেই সামনে টেনে এনেছেন। ইতিবাচক দিকগুলোকে তাঁরা ধামাচাপা দিয়েছেন। যেমন, “গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, হত্যা চেষ্টা, মোবাইল ফোন ছিনতাইসহ নানান অপকর্মের দায়ে অভিযুক্ত” একজন ব্যক্তিকে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হলে জন জীবনে তার বিরূপ প্রভাব পরত।
বিএনপি নেতা মান্নানকে আগে দুইবার বহিষ্কার করার ফলে স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনি আড়াই বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। মান্নান যেহেতু আবার বহিষ্কৃত হয়েছেন আবার আওয়ামী লীগ নেতা মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন। এ যেন এক অদ্ভুত সমঝোতায় ক্ষমতার ভাগাভাগি! দারুণ রাজনৈতিক ঐক্যমত্য! মান্নান নিজেও এ জন্য গর্ববোধ করতেই পারেন। তিনি উদারতা দেখিয়েছেন। তাঁর উদারতায় তাঁরই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুবিধা পেয়েছে। নিজেকে মহান নেতা হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরতে চাইলে দুই চার ডজন মামলা আর কয়েক বছর জেল খাটতে ভয়ের কিছু নেই।
রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটেও বিএনপি নেতারা এমন নজীর স্থাপন করেছেন। ২০১৩ সালে মেয়র নির্বাচিত হবার পর তাঁরাও কয়েক বছর করে মেয়রের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থেকেছেন। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের মেয়রের দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। নতুনদের সুযোগ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটা ঠিক যে তাদেরকেও মান্নানের মতো কিছু মামলায় পড়তে হয়েছে। তাতে কী! মামলা না খেলে কি বড় নেতা হওয়া যায়! আওয়ামী লীগের নেতাদের হারিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা দলের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। এখন মামলা মোকদ্দমা খেয়ে নিজেরা অনেক বড় রাজনৈতিক নেতা হবার সুযোগ পাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: একজন এমপির প্রত্যাশা উদ্ভট উটের পিঠে চলুক স্বদেশ!
তবে বিএনপির আরেক নেতা বরিশালের মেয়র অন্যদের মতো সৌভাগ্যবান নন, উদার নন। ২০১৩ সালে মেয়র হবার পর থেকে তিনি একাই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। অন্য কাউকে সুযোগ দেননি। তাতে তিনি কতটুকু লাভবান হয়েছেন? কোনো মামলা হয়নি তাঁর বিরুদ্ধে, একবারো জেলে যেতে হয়নি। জেল থেকে বের হবার পর ফুলের মালা গলায় পরার সুখ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। শুধু কি তাই, জেল খেটে বড় নেতা হবার সুযোগ থেকেও তিনি বঞ্চিত হলেন।
গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট এবং খুলনার কোনো মেয়রই দুর্নীতি বা অন্য কোনো ফৌজদারি অপরাধে আদালত কর্তৃক সাজা প্রাপ্ত নন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে; আদালত সবেমাত্র সেগুলো গ্রহণ করেছেন। কোনো মামলার বিচারে তাঁদের কেউ দোষী সাব্যস্ত হননি। তবু তাঁদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অথচ দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত একজন এবং সংবিধান লঙ্ঘন এবং আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডিত দুজন মন্ত্রী এখনো সরকারের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। একইভাবে দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত এবং আরেকজন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি, যিনি এখন কারাগারে, ক্ষমতাসীন দলের এমন দুজন সংসদ সদস্য হিসাবে বহাল আছেন। এসব দেখে মনে হয়, আইন সবার জন্য সমান হবে এমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। রাজনৈতিক দল মত এবং ক্ষেত্র ভেদে আইনের প্রয়োগে ভিন্নতা থাকতে পারে। এটা আমাদের নিজস্ব আবিষ্কার; আইনের শাসনের নতুন মডেল; উন্নয়নের রোল মডেলের মতো। এ মডেল আবিষ্কারের জন্য আমরা গর্ব বোধ করতেই পারি।
আরও পড়ুন: এরশাদকে আর ঠেকায় কে?
তবে স্থানীয় সরকারকে অতীতে সব সরকার অবহেলা করলেও বিএনপি নেতাদের যে নজীর স্থাপিত হয়েছে সেগুলো কিন্তু সব স্থানীয় সরকারে। এতে আবারো একটা বিষয় পরিষ্কার হল যে, তৃণমূল থেকেই অনেক বড় নেতার যেমন জন্ম হয়, তেমনি অনুসরণযোগ্য অনেক নজির স্থাপিত হয়।
স্থানীয় সরকারে স্থাপিত নজিরগুলো কেন্দ্রীয় সরকারও অনুসরণ করবে তেমন আশা না করাই ভালো। বড় বড় পদে যারা আছেন তাঁরা কেন তৃণমূল নেতাদের অনুসরণ করবেন? তৃণমূল নেতাদের উচিত বড়দের অনুসরণ করে কৌশল আয়ত্ত করা, যেমন, দুর্নীতিতে দায়ে অথবা আদালত অবমাননার দায়ে সাজা পেয়েও কি করে মন্ত্রী থাকা যায়, সংসদ সদস্য থাকা যায়।
আইনের শাসনের নয়া মডেলের সাথে খাপ খাইয়ে চলা শিখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে, খাপ খাইয়ে চলাটাই টিকে থাকার আসল দক্ষতা!
Comments