সংবাদ বিশ্লেষণ: এমপিদের ক্ষোভ সম্পূর্ণ অন্যায্য

সুপ্রিম কোর্ট

সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরে এসেছিল সেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ায় গত রবিবার সংসদে যেভাবে সুপ্রিম কোর্টকে আক্রমণ করা হয়েছে সেটা কোনভাবেই স্বাভাবিক নয়।

২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের আরও তিনটি সংশোধনী—পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী—বাতিল করেছেন। কিন্তু তখন একবারও সংসদ থেকে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। আদালতকে আক্রমণ করে কেউ বক্তব্যও দেয়নি।

বাংলাদেশে প্রথম সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া হয়েছিল যে সংশোধনীর মাধ্যমে সেই পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার পর সুপ্রিম কোর্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন সংসদ সদস্যরা। তারা ওই রায়কে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ বলেছিলেন।

দ্বিতীয় সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায়কেও স্বাগত জানিয়েছিলেন তারা।

১৯৯৬ সালে দেশে এক অস্থির রাজনৈতিক সময়ে তৈরি হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলোপ করতে ২০১১ সালেও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ব্যবহার করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

কিন্তু আওয়ামী লীগের করা ষোড়শ সংশোধনী যখন বাতিল হল ঠিক তখনই সংসদে উল্টো চিত্র দেখা গেল। গত বছর মে মাসে হাইকোর্ট সর্বশেষ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণার পর বিচারবিভাগের বিরুদ্ধে সংসদ থেকে তোপ দাগা হয়। গত সপ্তাহে আপিল বিভাগে রায় বহাল থাকার পর একইভাবে সমালোচনায় মুখর হতে দেখা গেল এমপিদের।

সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করতে গিয়ে গত রবিবার কয়েকজন এমপি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়কে ‘১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের চেতনা পরিপন্থি’ এমনকি ‘সংবিধানবিরোধী’ বলতেও ছাড়লেন না। এই রায়ের পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’ থাকতে পারে পর্যন্ত আশঙ্কা করেছেন কয়েকজন এমপি।

কিন্তু বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা যে এবারই প্রথম সংসদের হাত থেকে বেরিয়ে গেল তেমনটা নয়। এ ব্যাপারে সংসদের ক্ষমতাহীন হওয়ার ইতিহাসের দিকে দেখলে দেখা যাবে, ১৯৭২ সালে সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর মাত্র দুই বছর এই ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবারের মত সংসদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। তখন যে সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠন করা হয়েছিল সেই সংশোধনীতেই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া হয়েছিল।

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিন বছর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ছিল।

জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর ১৯৭৮ সালের সামরিক সরকার সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খর্ব করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান করেন।

এর পর জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক সরকারের অধীনে সংবিধান সংশোধনকে বৈধতা দেওয়া হয়।

সেই পঞ্চম সংশোধনীকে ২০১০ সালে সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করে। তবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধানকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈধ রাখেন আদালত।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সে বছরই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানকে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ সামরিক শাসনের সময় বিচারপতি অপসারণের যে বিধান হয়েছিল পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকেই পুনর্বহাল করে আওয়ামী লীগ সরকার।

কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের মনোভাবে পরিবর্তন আসে। এর পর সর্বশেষ আরেকবার সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করে বিচারপতিদের অপসারণে সংসদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে আনে। তখন এর কারণ হিসেবে বলা হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল জনগণের ক্ষমতাকে খাটো করে।

আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকেই এখন বলছেন ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে গেছে। যদি এমনটাই হয়ে থাকে তবে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান করেছিল সেটাই পুনর্বহাল হয়েছে সামরিক শাসনের আমলের বিধানটি নয়।

সর্বোচ্চ আদালতের সমালোচনা করতে গিয়ে কয়েকজন এমপি এটাও বোঝাতে চেয়েছেন যে গণতান্ত্রিক দেশে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা অবশ্যই পার্লামেন্টের হাতে থাকা উচিত।

কিন্তু ২০১৫ সালে কমনওয়েলথ সচিবালয় থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফল ভিন্ন কথা বলছে। কমনওয়েলথভুক্ত ৪৮টি দেশের বিচারক নিয়োগ এবং অপসারণ পদ্ধতি নিয়ে করা ওই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মাত্র ১৬টি দেশে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে আছে। বাকি ৩২টি দেশে সংসদকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সে সব দেশে বিচারপতি অপসারণের জন্য ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

যেসব দেশের সংসদ বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পেয়েছে সেই সব দেশে বিচারক নিয়োগের জন্য আলাদা কমিশন বা পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়েছে। ইংল্যান্ড, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশেই দীর্ঘ দিন থেকে ‘জুডিশিয়াল এপয়েন্টমেন্ট কমিশন’ কাজ করছে। এই জুডিশিয়াল এপয়েন্টমেন্ট কমিশন সম্পূর্ণভাবে সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করে।

কিন্তু এ ধরনের কোন জুডিশিয়াল এপয়েন্টমেন্ট কমিশন বাংলাদেশে নেই। বিচারপতি হতে ইচ্ছুকদের কী যোগ্যতা থাকতে হবে তা সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও গত চার দশকে এমন আইন করতে পারেনি আমাদের সংসদ।

বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত এই আইন প্রণয়নে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকার পরও আগের কোন সংসদ এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনি। চলতি ১০ম সংসদেও এ সংক্রান্ত কোন আলোচনা নেই।

সংসদ সদস্যদের নিজেদের বিবেক অনুযায়ী স্বাধীনভাবে সংসদে মত প্রকাশে ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বিধিনিষেধ আরোপ রাখা হয়েছে সেটা নিয়ে কথা বলতেও যেন তারা ভুলে গেছেন। যেসব দেশে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে রয়েছে সেখানে বাংলাদেশের ৭০ অনুচ্ছেদের মত কোন বিধান নেই।

৭০ অনুচ্ছেদের কারণে আমাদের নির্বাচিত সাংসদরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নিজেদের বিবেক ও স্বাধীনতা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে সংসদে ভোট প্রদান করতে পারেন না। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পেছনে সাংসদের এই স্বাধীনতা না থাকারও ভূমিকা রয়েছে বলে আদালতের রায়ে বলা হয়েছে।

গত রবিবার সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করার সময় সাংসদদের বক্তব্যেও সম্পূর্ণ দলীয় মতেরই প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। এক জন সাংসদের বক্তব্যেও ভিন্ন মত দেখা যায়নি।

Click here to read the English version of this news analysis

আরও পড়ুন: সংসদের বাইরে এমপিরা স্বাধীন!

Comments

The Daily Star  | English
CAAB pilot licence irregularities Bangladesh

Regulator repeatedly ignored red flags

Time after time, the internal safety department of the Civil Aviation Authority of Bangladesh uncovered irregularities in pilot licencing and raised concerns about aviation safety, only to be overridden by the civil aviation’s higher authorities.

11h ago