ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা

বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই প্রচলিত। তবে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় এর প্রচলন বেশি দেখা যায়। আশ্বিন ও চৈত্র মাসে দুর্গাপূজা পালিত হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয় দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয় দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কালে দুর্গাপূজা কেমন হতো সেটাও জানা যেতে পারে বৈকি।
Durga Puja at Thaku bari
ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই প্রচলিত। তবে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় এর প্রচলন বেশি দেখা যায়। আশ্বিন ও চৈত্র মাসে দুর্গাপূজা পালিত হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয় দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয় দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কালে দুর্গাপূজা কেমন হতো সেটাও জানা যেতে পারে বৈকি।

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এই উৎসব বহু আগে থেকেই পালিত হয়ে আসছে। মহালয়া থেকে শুরু করে বিজয়া দশমী পর্যন্ত সব আনুষ্ঠানিকতা। দুর্গাপূজার বিশেষ আনন্দ-উদযাপনে ঠাকুরবাড়িও ব্যতিক্রম ছিল না। বেশ ধুমধামের সঙ্গেই বাড়ির সবাই মিলে দুর্গাপূজা করতেন। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ১৭৮৪ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ নীলমণি এই দুর্গাপূজা শুরু করেন। দুর্গাপূজা প্রধানত ধনী পরিবারগুলোতেই আয়োজিত হতো।

বনেদি বাড়ির পূজা বলে একটি কথা আছে; কলকাতার ধনী পরিবারের পূজার ইতিহাস থেকেই তা এসেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মসূত্রেই ছিলেন জমিদার। তাঁদের বাড়ির সব পূজা-উৎসবই হতো অনেক জাঁকজমকপূর্ণ।

যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গতানুগতিক নিয়মে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করেননি। অনন্তের চৈতন্যই ছিল তাঁর সব কাজকর্ম ও ধ্যান-ধারণাজুড়ে। তিনি নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ঘর এবং গৃহকর্মের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছিলেন। কবিগুরু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, উৎসবের দিন একলার ঘর হয়ে ওঠে সবার ঘর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৩ সালে কলকাতার বোলপুর থেকে কাদম্বিনী দেবীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর মতবাদ লিখেছিলেন। তার মতে, ঈশ্বর সাকার ও নিরাকার দুই-ই। শুধু ঈশ্বর নয়, তাঁর মতে আমরা প্রত্যেকেই সাকার এবং নিরাকার দুই-ই। তিনি ঈশ্বরবাদ নিয়ে কোনো বাদ-বিবাদে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি আকারে, রূপে, কর্মে ঈশ্বরের উপাসনা করাতেই বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মূর্তি পূজা করতে চাইতেন না। তবে প্রতিমা নিয়ে তাঁর কোনো দ্বিমত ছিল না। তাঁর মতে, যদি কোনো বিশেষ মূর্তির মধ্যেই ঈশ্বরের আবির্ভাবকে বিশেষ সত্য বলে না মনে করা যায় তাহলেই তাতে আর কোনো সমস্যা থাকে না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন সৌদামিনী দেবীর একটি লেখা থেকে জানা যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পূজার বাড়িতে থাকতেন না। পূজার সময় ঠাকুরবাড়িতে যত আচার-অনুষ্ঠানই হোক না কেন সেখানে রবিঠাকুরের মা স্বামীকে ছাড়া কোনোভাবেই নিজেকে শামিল করতে পারতেন না। ষষ্ঠীর দিন শুধু ছেলে-মেয়েরাই নয়, আত্মীয়-স্বজন, কর্মচারী, ভৃত্য এবং ঝিদের নতুন জামাকাপড় বিলি করে দেওয়া হতো ঠাকুরবাড়ি থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন এবং তিনি প্রচুর খরচ করতেন। পূজার সময়ে মোয়া, ক্ষীর প্রভৃতি মিশিয়ে ফুটবলের মতো দেখতে একটি বৃহদাকার মিঠাই তৈরি করা হতো সবার জন্য।

বীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেকালের ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, পূজার দিনগুলোতে তাঁরা সন্ধ্যার দিকে দালানে যেতেন। সেখানে ধূপ জ্বালানো হতো। বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন বাদ্যযন্ত্রীরা। সন্ধ্যার আরতি দেখার জন্য এবং ঠাকুরকে প্রণাম করার জন্যই তাঁরা দালানে যেতেন। বিজয়ার দিন প্রতিমার নিরঞ্জনের মিছিলে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা যোগ দিতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবীর কথায়, ঠাকুরবাড়িতে যখন দুর্গোৎসব হতো তখন ছেলেরা বিজয়ার দিনে নতুন জামাকাপড় পরে প্রতিমার সঙ্গে যেত। আর মেয়েরা তখন তেতালার ছাদে উঠে প্রতিমা বিসর্জন দেখত। সৌদামিনী দেবীর লেখায় এও জানা যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজয়ার রাতে শান্তিজল সিঞ্চন ও ছোট-বড় সবার মধ্যে কোলাকুলি করাটা খুব পছন্দ করতেন।

ছাড়াও, সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, বিজয়ার দিন তাঁদের বাড়িতে গৃহনায়ক বিষ্ণু আগমনী ও বিজয়ার গান করতে আসতেন। অবনীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, বিজয়া তাঁদের জন্য খুব আনন্দের দিন ছিল। সেদিনও কিছু পার্বণী পাওয়া যেত। ঠাকুরবাড়ির যত কর্মচারী ছিলেন সবার সঙ্গে তাঁরা কোলাকুলি করতেন। বুড়ো চাকররাও এসে ঠাকুরবাড়ির ছোট-বড় সবাইকে প্রণাম করত। পরবর্তীকালে ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠিত “বিজয়া সম্মিলনী” প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের লেখায় জানা যায়, সেদিন ঠাকুরবাড়িতে মস্ত জলসা বসত। খাওয়া-দাওয়া হতো খুব। ওস্তাদ তানপুরা নিয়ে গানে গানে মাত করে দিতেন ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত সেই ঠাকুরবাড়ি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো এবং সালঙ্কার সেই প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়া হতো। প্রতিমা ভাসানোর সময়ও সেই স্বর্ণালঙ্কার খুলে নেওয়া হতো না। নৌকার মাঝি অথবা অন্য কর্মচারীরা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ওইসব গয়না তুলে আনত। কিন্তু সেই গয়না ফের ঠাকুরবাড়িতে নেওয়া হতো না।

তত্ত্বাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১০ বছর পরও ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজা হতো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথের মতে, দুর্গোৎসব সমাজের সবার সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট উপায়। তাই সবার প্রতি তাঁর আহ্বান ছিল দুর্গোৎসব নিয়ে কোনো হস্তক্ষেপ না করার। সম্ভবত, রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজের ছোট কাকার এই ধারণাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশকিছু প্রবন্ধে দুর্গা সম্পর্কে নানাভাবে আলোচনা করেছেন। “লোকসাহিত্য”-এর অন্তর্ভুক্ত “ছেলেভুলানো ছড়া” প্রবন্ধটিতে একটি বহু প্রচলিত ছড়া প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখা রয়েছে। সেখানে জানা যায়, আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তরবেদনা আছে, মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অল্পবয়স্ক মেয়েদের বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সংসার করতে হয়। আর মেয়ের এই ত্যাগের জন্য পুরো বাংলাদেশে সবারই হৃদয় কাঁদে। সেই করুণ স্নেহ বারবার শারদীয় দুর্গোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করে। তাই রবিঠাকুর একে বাঙালির অম্বিকাপূজা অথবা বাঙালির কন্যাপূজা বলেছেন। আগমনী এবং বিজয়া হলো বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান।

এই পূজা-পার্বণ যে সমাজের সব মানুষকে একত্র করে মিলনে বাঁধে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একমাত্র এ বিষয়টিই টেনেছে। তিনি সবসময় বোঝাতে চেয়েছেন মিলনের মধ্য দিয়ে অসীমকে পাওয়া যায়, কোনো দেবতাকে নয়। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তাই দুর্গাপূজার সময়গুলোতে তিনি পূজার চেয়েও বেশি আনন্দ উপভোগ করতেন মানুষের মিলনমেলায় এসে।

Comments

The Daily Star  | English

Ex-public administration minister Farhad arrested

Former Public Administration minister Farhad Hossain was arrested from Dhaka's Eskaton area

3h ago