রাজনীতি করছি, অভিনয় নয়: রূপা গাঙ্গুলি

তিন দশকের অভিনয় জীবনের সমাপ্তি টেনে কয়েক বছর আগে রাজনীতিবিদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন কলকাতার প্রখ্যাত অভিনেত্রী রূপা গাঙ্গুলি; পদ্মা নদীর মাঝির কপিলা। যুক্ত হয়েছেন ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির রাজনীতির সাথে; হয়েছেন রাজ্যসভার সদস্য।
রূপা গাঙ্গুলি। ছবি: সংগৃহীত

তিন দশকের অভিনয় জীবনের সমাপ্তি টেনে কয়েক বছর আগে রাজনীতিবিদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন কলকাতার প্রখ্যাত অভিনেত্রী রূপা গাঙ্গুলি; পদ্মা নদীর মাঝির কপিলা। যুক্ত হয়েছেন ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির রাজনীতির সাথে; হয়েছেন রাজ্যসভার সদস্য।

রাজনীতিতে নেমেছেন আটঘাট বেঁধেই। অভিনয় জীবনের পাট চুকিয়ে এখন তিনি পুরোপুরি রাজনীতির ময়দানে। তিনি বলেন, “আমি যেদিন ঠিক করেছি পলিটিক্সে জয়েন করবো তার ছয় মাস আগে থেকেই অভিনয়ের সমস্ত কাজ বন্ধ করেছি। আমার চারটা ফিল্ম আগে থেকে নেওয়া ছিল-সেই চারটা শেষ করেছি। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর আমার তিন মাসের শুটিং বাকি ছিল- সেটা ওই সময়ই এনাউন্স করেছিলাম। বলেছিলাম এই তিনমাসের মধ্যে মাঝে মাঝে শুটিং থাকবে।”

ঘোষণা অনুসারে অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেছেন। তারপর পুরোপুরি অভিনয় বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রডিউসারদের সাথে যোগাযোগ রাখেন না। কোনো প্রডিউসার বা ডিরেক্টর ফোন করলে তার সাথে নমস্কার: ধন্যবাদ দিয়ে কথা শেষ করেন। কেউ কোনো চরিত্রের গল্প শোনাতে চাইলে আগ্রহ দেখান না। গল্প শুনলে মনে হবে এই রোলটা দারুণ। আকর্ষণ করতে পারে। তিনি বলেন, “রাজনীতিতে আসার পর পর আমি কারো গল্পও শুনিনি। যে বছর পলিটিক্সে ঢুকি সেই বছর ১২টার মত প্রজেক্ট রিফিউজ করেছি।”

তবে অভিনয়ের প্রতি এখনও তিনি আকর্ষণ বোধ করেন। তিনি বলেন, “৩০ বছর ধরে এই কাজটা করেছি। এর প্রতি আমার আকর্ষণ আছে। আমার ভালোবাসা আছে। অভিনয় আমাকে অর্থ দিয়েছে, যশ দিয়েছে, সম্মান দিয়েছে। ছাড়াটা তো খুব সোজা কথা নয়। আমি তো মানুষ।”

কমনওয়েলথ পারলামেন্টারি কনফারেন্সে যোগ দিতে ঢাকায় রূপা গাঙ্গুলি। ছবি: সংগৃহীত

কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতের সংসদীয় দলের একজন সদস্য হয়ে ঢাকায় এসেছেন রূপা গাঙ্গুলি। গতকাল [নভেম্বর ৭] সম্মেলনের এক ফাঁকে দ্য ডেইলি স্টার এর সাথে আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেন তাঁর অভিনয় এবং রাজনৈতিক জীবনের কিছু কথা।  

রাজনীতিকে সমাজসেবার অংশ হিসেবেই মনে করেন রূপা। তিনি বলেন, “ছোট বেলা থেকেই আমার আয়ের ৫০ শতাংশের ওপরে সমাজসেবার কাজে ব্যয় করে আসছি। এজন্য সামাজিক কাজের বিষয়টি সব সময় আমার মাথার মধ্যেই ছিল। আমি রাজনীতিকে সোশ্যাল ওয়ার্কের এক্সেটেনশন হিসেবে দেখি।”

তার মতে, বর্তমানে রাজনীতিকে এক্সেটেনশন অব সোশ্যাল ওয়ার্ক হিসেবে দেখা হচ্ছে না। এটাকে পাওয়ার গেম বলেই দেখা হয়। এই পাওয়ার গেম শব্দটাকে আপনি কীভাবে ব্যবহার করবেন সেটা দেখার বিষয়। এই পাওয়ার গেমকে সুপেয় করবেন নাকি দুরপেয় করবেন। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আপনি ভালো দিকে পরিচালনা করবেন না খারাপ দিকে পরিচালনা করবেন-সেটা আপনার ওপর ডিপেন্ড করবে। সেটা কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর ডিপেন্ড করে না। সেই মানুষটা কোন প্রফেশনে ছিল তার ওপর নির্ভর করে। তার মানুষ হওয়া, বড় হওয়ার ওপর নির্ভর করে।”

অভিনয় পেশার সমাপ্তি হলেও রাজনীতিতে কি কোনো কোনো সময় অভিনয় করতে হয় না?—এমন প্রশ্নের জবাবে রূপা গাঙ্গুলি জানান তার অভিনীত সিনেমার চরিত্রগুলো একেক সময় একেক রকম ছিল। সেগুলোর কোনোটা জীবন থেকে নেওয়া আবার কোনোটা গল্প বা কাহিনী থেকে তুলে আনা। কখনো তাঁর নিজের সাথে চরিত্রগুলোর মিল থাকতো আবার কখনো থাকতো না। সেটা যে কেবল অভিনয় ছিল তা নয়, অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রটাকে অন্তর থেকে সেই মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করা। আর সে কারণে তিনি একই সময়ে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করতেন না। তিনি বলেন, “আমি সময় নিয়ে একটা চরিত্রে অভিনয় করতাম। আজ একটা চরিত্র, কাল আবার নতুন চরিত্র এটা আমি কখনো করতে পারতাম না।”

তাঁর ভাষায় তিনি এখন রাজনীতি করছেন, অভিনয় নয়। তিনি যা বিশ্বাস করেন, সেটাই বলেন। “আমি তো লোকের সঙ্গে লড়ে যাই, আমার কোন সমস্যা হয় না। আমি কোনো পদের জন্য রাজনীতি করতে আসিনি। সমাজসেবা ভেবেই রাজনীতি করতে এসেছি। রাজনীতিতে আসার আমার প্রায় তিন বছর হতে চলল—তার তার মধ্যে কোথাও এ ধরনের অবস্থা ফেস করতে হয়নি। কোথাও অ্যাক্টিং করতে হয়নি। বস্তুত সিনেমা জগতেও কিন্তু তাই। পদ্মা নদীর মাঝিতে কপিলা চরিত্রে অভিনয় করেছি। আমি কি সত্যিকারের কপিলা ছিলাম? না। আমি না কখনো মাছ ধরেছি, না কখনো জেলেনি ছিলাম। আমি এটা তখন তার (কপিলার) অবস্থার মত করে বুঝার চেষ্টা করেছি। আবার যখন ‘নয়নচাঁপার দিনরাত্রি’ করছি—সত্যিই কি আমি ভোর চারটায় ক্যানিং থেকে রাস্তায় বেড়িয়ে অন্য লোকের বাড়িতে কাজ করতে যেতাম? না। কিন্তু তার অবস্থানে বুঝতে পেরেছি। সেখানে রাজনীতিতে যখন আমার দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি আমার দলেও ৫০ রকমের লোক আছে। সবার সঙ্গে আমার একমত হবার তো দরকার নেই। সবার সঙ্গে একমত তো কখনই হওয়াও যায় না। সবাইকে খুশি করা যায় না। সেই চেষ্টা করাও বৃথা। সেটা করার জন্যও আমি রাজনীতিতে আসিনি। আমি আমার লিডারশিপকে দেখছি। আমার মোদি জি-কে পছন্দ। আমিত শাহকে পছন্দ।”

রূপা গাঙ্গুলি। ছবি: সংগৃহীত

বলা হয় রাজনীতিবিদরাও অভিনেতা, জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা অভিনয় করেন। এখন কাছ থেকে রাজনীতিটাকে দেখছেন। রাজনীতিতে আসার পর প্রচলিত ধারণাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?—জবাবে তিনি বলেন, “গত দু-তিন বছর আগেও ভারতে এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি আর থাকবে না। দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল যে রাজনীতিবিদরা ইমোশনাল হতে পারবে না, পলিটিশিয়ান হলে চোখে জল আসতে পারবে না। সত্যি কথা বলা যাবে না।”

“এই নিয়মটা যুগ যুগান্ত ধরে চলবে তার তো মানে হয় না। এমন কি কোন নিয়ম আছে বা সংবিধানে কি লেখা আছে রাজনীতিবিদকে এমন হতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা সাধারণ রাজনীতিবিদদের দেখেই এরকম একটা ধারণা তৈরি করি। তার সঙ্গে ‘পলিটিশিয়ান’ শব্দটা আর যাতে জড়িয়ে ফেলা না যায়, তার জন্য নতুন জেনারেশনের পলিটিশিয়ানরা আসছে যারা সত্যিই নতুনভাবে সমাজটাতে তৈরি করতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন আসছে, সমাজে পরিবর্তন আসবে। আর সামাজিক পরিবর্তন এলেই সার্বিক পরিবর্তন আসবে। একটা দেশের পরিবর্তন আনার জন্য সামাজিক ও মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।”

রূপা গাঙ্গুলি মনে করেন রাজনীতিতে বিরোধী দলের যে গুণ আছে সেটাকে অস্বীকার করা ঠিক নয়। কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়, অপজিশনকে সব সময় সম্মান নিয়ে বিরোধিতা করা দরকার। আর রুলিং পার্টিরও অপজিশনের কথাটা মেনে সেটাকে কি করে সংশোধন করা যায় সেটা করা দরকার।

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, দেখলেন একটা যায়গায় রাস্তা ভাঙ্গা আছে। রুলিং পার্টি বলবে, হ্যাঁ আমাদের কিছুটা রাস্তা এখনো মেরামত করতে বাকি আছে। এটা আমরা এত এত অবধি করেছি। আর অপজিশন বলবে হ্যাঁ, দেখুন এইটুকু হয়েছে বটে বাকিটা কিছুই হয়নি। দুটোর কোনটাই কিন্তু পুরো সত্য আর পুরো মিথ্যা নয়। দুজনের কেউই কিন্তু পুরো অ্যাক্টিং করছে না। হাফ গ্লাস জল, গ্লাস ফাকা দেখবো না ভর্তি দেখবো তার মত। এটা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে।

ভবিষ্যতে অভিনয়ে ফিরবেন কি না? জবাবে তিনি বলেন, “ফিউচার নিয়ে আমি খুব একটা ভাবি না। আমার ভাবনা হচ্ছে—আমি আজকের দিনটা গতকাল থেকেই ঠিক করতে পেরেছি। কালকে যেটা করেছি আজকে কি তার থেকে বেটার হয়েছে? বেশি দূরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি ভাবিই না। সামনের এক/দুই বছরের বেশি ভবিষ্যৎ আমি দেখি না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে হয়তো আনন্দ হবে না হয় দুঃখ হবে। হতাশা আসবে না হয় মাথা চড়ে যাবে, কোনো একটা হবে। এজন্য কোনটারই দরকার নেই আমার।”

আপনার অভিনীত সেরা চরিত্র কোনটি? যেটার জন্য আপনি তৃপ্ত হয়েছেন। এমন প্রশ্নকে কঠিন মনে করেন রুপা গাঙ্গুলি। “আমি নিজের সম্বন্ধে বেশি রকমের ক্রিটিক্যাল। আমি ৩০ বছর ধরে অভিনয় করছি। আজকের তারিখে দাঁড়িয়ে আমার কোনো পুরনো ছবি দেখে নিজেকে তৃপ্ত মনে হয় না। কারণ  কোনো ছবি করার চার-পাঁচ বছর পর দেখি-এটা যখন করেছি তখন আমার বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা ছিল না। আজকে আমি সেটা বুঝি। কিন্তু আজকে সেটা করবার মত আমার সময় বা বয়স নেই। সারা জীবন ধরেই আমার এটাই মনে হয়েছে। এজন্য তৃপ্ত হওয়ার মত কোনো ছবির কথা আমি বলতে পারবো না।”

তবে কয়েকটা সিনেমা করে ভালো লেগেছে এমনটাই জানালেন রূপা গাঙ্গুলি। “যেমন ‘অবশেষে’- আমি ওই ছবিটাকে নিজের সঙ্গে রিলেট করতে পেরেছি। অবশেষের জন্য ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলাম, আমার ভালো লেগেছিল-তবে তারজন্য নয়। ওই ছবিটার গল্পটা শুনে একটা আন্তরিকতা তৈরি হয়েছিল আলাদা রকমের। ‘অন্তরমহল’ ছবিটা নিজের কাছে খুব কঠিন ও ভালো বলে মনে হয়েছে। কারণ ঋতুর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। ছবিটাতে বড় বউয়ের অসহনীয় বেদনা সেটা প্রদর্শন করে।”

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ রূপা গাঙ্গুলির কাছে সারা জীবনের ফেভারিট সিনেমা। এত বেশি প্রিয় হবার কারণ জানান তিনি। “এটা দুই বাংলার ছবি। এই বাংলাদেশে আমার বাবার জন্ম, মায়ের জন্ম। আমার বাবা মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমাকে তাঁর ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে যেতে হয়েছে। তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট চেঞ্জ করেননি। তিনি বলেছিলেন আমি বাংলাদেশের পাসপোর্টেই মরবো। এজন্য তাঁর ভিসা পাসপোর্ট রিনিউ করে যেতে হয়েছে আমাকে। উনি বলতেন আমি নারায়ণগঞ্জেই মরবো। বাবা বাংলাদেশ ছেড়ে যেতেই চাননি। আমি জবরদস্তি করে হাতে পায়ে ধরে ইন্ডিয়ান হাইকমিশন থেকে অনেক চেষ্টা তদ্বির করে তাকে অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে গেছি। বাবার জন্য বাড়ি কিনে সেখানে সেটেল্ড করিয়েছি।”

রূপা বলেন, “নারায়ণগঞ্জে নদীর পাড়ে বাড়ি ছিল আমাদের। আমার বাড়িটার কথা মনে আছে কিন্তু জায়গাটা মনে নেই। ছোট বেলায় এসেছিলাম অনেকবার। আর পদ্মা নদীর মাঝি করার সময় আমি বহুবার এসেছি। এক বছর ধরে এসেছি। আমার জন্য সুখকর ছিল যে হাবিব ভাই আমাদের প্রডিউসার ছিলেন। তিনি আমাকে বহু যত্ন করে আবার আমাকে বাংলাদেশে ঘুরিয়েছেন। এটা আমার একটা বড় পাওয়া।”

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago