প্যারাডাইস পেপারস: মিন্টুর তেল কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ ও ইউনোকল বিতর্ক

প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম এসেছে। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া নথি থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯৯৯ সালের ৯ আগস্ট উত্তর আটলান্টিকের দ্বীপ বারমুডায় মিন্টু এনএফএম এনার্জি লিমিটেডের নিবন্ধন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি ইউনোকলের এক শতাংশ শেয়ারের মালিকানা পাওয়ার পর তিনি এই নিবন্ধন করান। বাংলাদেশে ব্যবসায়িক সুবিধা পেতে ইউনোকল মিন্টুকে অংশীদার বানিয়েছিল।
Paradise Papers

প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম এসেছে। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া নথি থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯৯৯ সালের ৯ আগস্ট উত্তর আটলান্টিকের দ্বীপ বারমুডায় মিন্টু এনএফএম এনার্জি লিমিটেডের নিবন্ধন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি ইউনোকলের এক শতাংশ শেয়ারের মালিকানা পাওয়ার পর তিনি এই নিবন্ধন করান। বাংলাদেশে ব্যবসায়িক সুবিধা পেতে ইউনোকল মিন্টুকে অংশীদার বানিয়েছিল।

ব্রিটেনের অধীনস্থ বারমুডা নামমাত্র কর দিয়ে কোম্পানি খোলার সুযোগ দেয়। এ কারণে দ্বীপটি ট্যাক্স হেভেন হিসেবে পরিচিত। নিজ দেশে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে বিশ্বের ক্ষমতাধরদের অনেকেই এখানে কোম্পানির নিবন্ধন নিয়ে থাকেন।

পানামা পেপারসের মতো এসব নথি প্রথমে জার্মান দৈনিক সুডডয়চে জেতুং এর হাতে আসে। পরে সেসব নথি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) হাতে তুলে দেয় তারা। বারমুডায় অবস্থিত অ্যাপলবাই নামের এক আইনি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান থেকে এগুলো ফাঁস হয়। নথিগুলো পরীক্ষা করে দেখছেন ৬৭টি দেশের ৩৮০ জন সাংবাদিক।

ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যায়, মিন্টুর স্ত্রী নাসরিন ফাতেমা আউয়াল, তাদের তিন ছেলে তাবিথ মোহাম্মদ আউয়াল, তাফসির মোহাম্মদ আউয়াল ও তাজওয়ার মোহাম্মদ আউয়াল এনএফএম এনার্জির শেয়ারের মালিক। মিন্টুর ব্যবসা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে এনএফএম এনার্জি সম্পর্কে বলা হয়, “গ্যাস অনুসন্ধান ড্রিলিংয়ের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর একটি এনএফএম এনার্জি। শেভরন বাংলাদেশে এর বিনিয়োগ রয়েছে। এই কোম্পানি ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করছে।” তবে শনিবার সন্ধ্যা থেকে ওয়েবসাইটটিতে আর ঢোকা যাচ্ছে না।

জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ইউনোকলের শেয়ারের মালিক ছিলেন আব্দুল আউয়াল মিন্টু। বছর তিনেক আগে আরেক মার্কিন তেল কোম্পানি শেভরন মিন্টুর শেয়ার কিনে নেয়।

ইউনোকলের শেয়ারের মালিক থাকাকালে বেশ কিছু বিতর্কিত কাজে জড়িয়ে পড়েন মিন্টু। এর একটি ছিল সিলেটের বিবিয়ানা থেকে গ্যাস রপ্তানির জন্য তার তৎপরতা। ইউনোকলও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ও ২০০১ সালে বিএনপি সরকারের সময় বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রপ্তানির চেষ্টা চালা

১৯৯০ দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের যাতায়াত থাকলেও ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে হঠাৎ বিএনপিতে যোগ দেন মিন্টু।

আব্দুল আউয়াল মিন্টু গতকাল তার অফিস থেকে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলার সময় ইউনোকল ও পরবর্তীতে শেভরনের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকার কথা জানান। শেভরনের সাথে এখন কোনো সম্পর্ক নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেক দিন আগে শেভরনের এক শতাংশ শেয়ারের মালিকানা ছিল আমার।” শেভরনের সাথে ব্যবসার কারণেই তার নাম প্যারাডাইস পেপারসে এসে থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন। এর ব্যাখ্যায় বলেন, আন্তর্জাতিক কোম্পানির সাথে ব্যবসা হওয়ার কারণেই তাকে অফশোর কোম্পানি খুলতে হয়েছিল। তবে অবৈধভাবে টাকা পাঠানোর কথা অস্বীকার করেন তিনি।

তার ভাষ্য, “এত বছর পর কেন আমার নাম প্যারাডাইস পেপারসে এলো জানতে আমেরিকায় পার্টনারদের ফোন দিতে হবে।” এর পরই তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন বলে যোগ করেন।

ইউনোকলে তার ভূমিকার কথা জানাতে গিয়ে মিন্টু বলেন, জ্বালানি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও গ্যাস উত্তোলনে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার অভাবের কথা জেনেই তিনি ইউনোকলের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, “আমার নিজের স্বার্থ ছিল কিন্তু দেশের স্বার্থকে আমি সবার সামনে রেখেছিলাম।”

গ্যাস রপ্তানি চেষ্টার সাথে ইউনোকলের সংযোগের ব্যাপারে মিন্টু বলেন, তখন আমি শুনেছিলাম বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। এ কারণেই রপ্তানিকে সমর্থন জানিয়েছিলাম। কিন্তু যখন প্রকৃত অবস্থা জানতে পারলাম তখন আমিও মত পরিবর্তন করি।”

তার প্রশ্ন, “আমার আন্তর্জাতিক ব্যবসা রয়েছে। তাহলে অফশোর কোম্পানি খোলায় সমস্যা কোথায়?”

ইউনোকল বিতর্ক

প্যারাডাইস পেপারসে দেখা যাচ্ছে, বারমুডায় বেশ কিছু কোম্পানির নিবন্ধন নিয়েছিল ইউনোকল। এর মধ্যে রয়েছে, ইউনোকল বাংলাদেশ লিমিটেড, ইউনোকল বাংলাদেশ এক্সপ্লোরেশন লিমিটেড, ইউনোকল ব্লক ৫ লিমিটেড, ইউনোকল ব্লক ১০ লিমিটেড, ইউনোকল ব্লক ১৩ ও ১৪ লিমিটেড ইত্যাদি। ইউনোকল ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে যখন এসব কোম্পানির নিবন্ধন নেয় তখন বাংলাদেশে তাদের সম্পদ বলতে কোনো কিছুই ছিল না।

১৯৯৩ সালে ইউনোকল যখন ব্লক ১২, ১৩ ও ১৪ নিয়ে বারমুডায় দুটি কোম্পানির নিবন্ধন নেয় তার দু বছর পর এই ব্লকগুলোতেই গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য মার্কিন আরেক কোম্পানি অক্সিডেন্টালের সাথে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) করে সরকার। ব্লকগুলো এখন বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে নামে পরিচিত।

১৯৯৬ সালের শেষ দিকে এসে বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে আসে ইউনোকল । ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্র নিয়ে চুক্তির জন্য তারা চাপ দেয়। কিন্তু ইউনোকলের সাথে চুক্তি দেশের স্বার্থ পরিপন্থি ১৯৯৮ সালে এমন একটি পরামর্শ প্রতিবেদন আসার পর সরকার চুক্তির ব্যাপারে অগ্রসর হয়নি।

সেসময় মৌলভীবাজারের মাগুরছড়া গ্যাস ক্ষেত্রে বড় দুর্ঘটনা ঘটায় অক্সিডেন্টাল। দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে তারা। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে ১২ নম্বর ব্লকে বিবিয়ানায় উত্তলোনযোগ্য পাঁচ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পায় কোম্পানিটি। এই অনুসন্ধানের এক বছর পর ইউনোকলের কাছে সব সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে বাংলাদেশে থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয় অক্সিডেন্টাল।

‘বাংলাদেশে নিজেদের কার্যক্রম সুগম করতে’ আব্দুল আউয়াল মিন্টুকে এক শতাংশ শেয়ারের মালিকানা দেয় ইউনোকল। ইউনোকল বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তা গ্রেগ গ্রিটার্স সে সময় দ্য ডেইলি স্টারকে এই তথ্য দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করার পর থেকেই ইউনোকল বলতে থাকে যে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কম। এর জন্য তারা বিবিয়ানা থেকে ভারতে গ্যাস রফতানির অনুমতি আদায়ের চেষ্টা শুরু করে। ওই গ্যাস ক্ষেত্রটিতে প্রথমবারের মত তারাই ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালিয়ে এর বিশাল মজুদের কথা নিশ্চিত করে।

কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার গ্যাস রফতানিতে আগ্রহী ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ২০০০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ঘোষণা দেন ৫০ বছরের দেশীয় চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ গ্যাস রপ্তানি করবে না।

শেখ হাসিনার এই ঘোষণার পর ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে হঠাৎ বিএনপিতে যোগ দেন আব্দুল আউয়াল মিন্টু। নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে বিএনপি।

২০০২ সালের শুরুর দিকে দেশে গ্যাসের ব্যবহার নিয়ে পরামর্শের জন্য একটি জাতীয় কমিটি করে বিএনপি সরকার। গ্যাস রপ্তানির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্যও কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইউনোকলের পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত দুজন বাদে ওই কমিটির অন্য সব সদস্য গ্যাস রপ্তানির বিরোধিতা করে বলেন, সামনের বছরগুলোতে গ্যাস সংকটে পড়বে বাংলাদেশ।

তখন বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়নের কাজ ধীর গতিতে এগোয়। তবে স্থানীয় বাজারের চাহিদা বিবেচনায় ২০০৪ সালে এসে গ্যাসক্ষেত্রটির উন্নয়ন কাজ শুরু করে ইউনোকল।

২০০৫ সালের এপ্রিলে বৈশ্বিকভাবে ইউনোকলকে কিনে নেয় শেভরন। সেসময় শেভরন বাংলাদেশের প্রধান বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেই গ্যাসের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে ফরে রপ্তানির কোনো দরকার নেই। তখন থেকেই বিতর্ক ছাড়াই দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে শেভরন।

দেশের গ্যাসের চাহিদার অর্ধেকই এখন সরবরাহ করে শেভরন।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago