বুদ্ধিজীবী কর্নেল কাদিরের জীবন: অনুসন্ধানী পাঠকের খোরাক

পাক-হানাদার বাহিনী চট্টগ্রামে আমাদের ৭০ পাঁচলাইশের বাসা থেকে বাবা লে. কর্নেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদিরকে ধরে নিয়ে গেলো ১৭ এপ্রিল। তারপর আর খোঁজ নেই! একজন জলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ হারিয়ে গেলেন! তখন বুঝতে পারিনি, এই হারিয়ে যাওয়া মানে আর ফিরে না আসা। তখন বুঝতে পারিনি, এই হারিয়ে যাওয়া মানে শহীদ হওয়া। তখন বুঝতে পারিনি, এই হারিয়ে যাওয়া মানে মাটির নিচে চলে যাওয়া, সমস্ত অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়ে।
Book review

পাক-হানাদার বাহিনী চট্টগ্রামে আমাদের ৭০ পাঁচলাইশের বাসা থেকে বাবা লে. কর্নেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদিরকে ধরে নিয়ে গেলো ১৭ এপ্রিল। তারপর আর খোঁজ নেই! একজন জলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ হারিয়ে গেলেন! তখন বুঝতে পারিনি, এই হারিয়ে যাওয়া মানে আর ফিরে না আসা। তখন বুঝতে পারিনি, এই হারিয়ে যাওয়া মানে শহীদ হওয়া। তখন বুঝতে পারিনি, এই হারিয়ে যাওয়া মানে মাটির নিচে চলে যাওয়া, সমস্ত অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়ে।

এগুলো একজন সন্তানের কথা তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে। সে সন্তান আমাদের পরিচিত সাংবাদিক ও বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার নাদীম কাদির। মুক্তিযোদ্ধা বাবার উপর লেখা তাঁর বই ‘মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায়’। সত্য অনুসন্ধানী পাঠকের আত্মার খোরাক এই বইটি। একুশে বইমেলায় জাগৃতি থেকে প্রকাশিত হয়েছে বইটি।

‘মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায়’-এ দেখি একজন তুখোড় সাংবাদিক হয়েও কোনো ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ভণিতার আশ্রয় না নিয়ে সোজা-সাপটা ভাষায় নাদীম কাদির বর্ণনা করেছেন তার জীবনের অবিচ্ছেদ একটি অংশ। ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া তার এই অংশটি আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য জানা খুবই জরুরি। যদিও ঘটনার সময়কালে লেখক খুবই ছোট ছিলেন। কিন্তু, সময়ের বুকে পা রেখে সর্বোপরি যোগ্য সন্তানের পরিচয় দিয়েছেন নাদীম কাদির-- ৩৬ বছর পর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নতুনভাবে জানিয়ে দিয়ে। তিনি আর কেউ নন, তিনি শহীদ লে. কর্নেল কাদির। তিনি ১৯২৯ সালের ২ জানুয়ারি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার মোস্তফাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে আর্মি স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের আগে তিনিই একমাত্র বাঙালি যিনি ভার্জিনিয়ায় ইউএসএ আর্মি স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ বিশেষ কোর্স করেন এবং ১৯৭১ সালে তেল ও গ্যাস উন্নয়ন সংস্থার চিফ কন্ট্রোলার অব অপারেশনস ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলে কী ঘটেছিল প্রাণপ্রিয় মুহম্মদ আব্দুল কাদিরের জীবনে? জেনে নেই মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান নাদীম কাদিরের বই থেকে--

৮ মার্চ ১৯৭১। রেডিও পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ পুনঃপ্রচার করা হয়। সবাই রেডিওর ভাষণ শুনছেন। বাবার হুকুমে সবাই চুপ!

ভাষণ শেষ হতেই, “জয় বাংলা, জয় বাংলা” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন বাবা। মা তাঁকে চুপ থাকতে বললেন। মা হুঁশিয়ার করে বলে, “তুমি সেনা অফিসার, কেউ শুনলে বিপদ হবে।” তবে বাবা নিশ্চিত, ‘বাংলাদেশ’ হবেই। আমরা বাংলাদেশের বড় বড় পতাকা ও কালো পতাকা আমাদের বাসার সামনে উড়িয়ে দিলাম। আর অফিসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম সাহেবসহ অনেককে নিয়ে বাবা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন।

বিহারিদের চোখে পড়ল বিষয়টি। ওরা নানানভাবে হুমকি দিতে শুরু করলো বাবাকে। যখন পরিস্থিতি উত্তেজনাকর তখন একদিন বাবা পাড়ার বাঙালিদের বললেন, ওদের জিনিস যেন কেউ না কেনে। চলে যাক ওরা পাকিস্তানে। আমাদের পাঁচলাইশের বাসার পাশেই দুটি বিহারি পরিবার ছিলো। তারা সব বিক্রি করে তড়িঘড়ি করে পাকিস্তান চলে গেলো। এর মধ্যে বাবা ক্যাপ্টেন রফিক ও অন্যান্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেন।

২১ বা ২২ মার্চ ১৯৭১, মেজর (পরে রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া আমাদের বাড়িতে আসেন। সামনে কি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে তাদের মধ্যে আলাপ হয়। এ ব্যাপারে পরে মায়ের কাছ থেকে জেনেছিলাম। তবে মনে আছে, বাবা আর মেজর সাহেব বৈঠকখানায় এবং মা ও বেগম জিয়ার কোনো বিষয়ে বাক-বিতণ্ডা হয়, যা বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছিল। এরপর পাক বাহিনীর আগমন-- ২৫ মার্চ ঢাকায় এবং ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে।

 

পরদিন সকালে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম বিহারিরা বড় বড় রামদা আর তলোয়ার নিয়ে বাঙালিদের মারছে। প্রবর্তক সঙ্ঘে গুলির শব্দ আর সাদা কাপড়ে মোড়ানো দেহগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ভয়ে জানটা শুকিয়ে গেল! বাবা খুব চিন্তিত! তখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি যে, আমাদেরও যে কোনো সময় মেরে ফেলতে পারে। তবে এতো বছর পর পেছনে তাকিয়ে যখন দেখি, তখন মনে হয় আমাদের সবাইকে বাবার সাথে মেরে ফেললেই ভালো হতো! বাবাকে মাঝখানে কয়েকদিন পাইনি। মা বলতো কাজে গেছে। হঠাৎ একদিন দেখি বাবা! মুখে দাড়ি এবং ভীষণ ক্লান্ত চেহারা। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে কোথায় গিয়েছিল? বললো, কাজে। “তুমি চিন্তা করো না, পাপা আছে”- এই বলে আমাকে আশ্বস্ত করল।

তারপর এক ভোরে ১৪ বা ১৫ এপ্রিল ১৯৭১ ঘুম ভেঙে দেখি শুধু লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে আর গামছা নিয়ে বাবা বের হয়ে যাচ্ছে। “পাপা কই যাও?” আমি জিজ্ঞাসা করতেই, বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তুমি ঘুমাও বাবা। পাপা এখানেই আছে।” ক্যাপ্টেন রফিক এবং এম আর সিদ্দিকী গাড়ি পাঠাবেন আমাদের নিয়ে যেতে- এমন একটি আশা ছিল বাবার। এমন কথাও হয়েছিল। কিন্তু আসলেই আমরা তা বুঝতে পারিনি, বা জানতে পারিনি গাড়িটা এসেছিলো কি না?

তারপর এলো সেই ভয়াবহ ১৭ এপ্রিল ১৯৭১!

আমরা নাস্তা করছি আমাদের চট্টগ্রামের ৭০ পাঁচলাইশের বাসায়। পাপা নাস্তা শেষ করে তার ঘরে গেছে। হঠাৎ বাসার সামনে কুকুরগুলো চিৎকার আর ছোটাছুটি করছিল। আমাদের দুটো কুকুর ছিলো। যেগুলো প্লেনে করে আমাদের সাথে পাকিস্তান থেকে আসে।

দরজায় বুটের লাথি। ভয়ংকর! আমার মা আর রুবিনা বাবার শোয়ার ঘরে। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, দরজা খুলব কি না? উনি বললেন, “খুলে দাও বাবা।”

বাসায় ছিল বাবুর্চি মান্নান আর ব্যাটম্যান সিপাহী গনি মিয়া। অন্য স্টাফদের বাবা বিদায় করে দিয়েছিলেন। ওরা দুজন রান্নাঘরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।

আমি দরজা খুলতেই পাক সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ১০-১২ জন সিপাহীসহ ঢুকেই আমাকে উর্দুতে জিজ্ঞাসা করল, “আব্বু কাহা হে?” (বাবা কোথায়?)

আমি বললাম, “বেডরুম হ্যা।” “চালো।” আমার পেছন পেছন ওরা বেডরুমে ঢুকলো। সময় হবে সকাল ৯:০০ টা।

এখন মনে পড়লে আমার অবাক লাগে, এমন ভয়াবহ সময়েও সে এতো নির্বিকার ছিল। উর্দু ভাষায় সেই ক্যাপ্টেন বললো যে, আমার বাবা ‘গাদ্দার’ অর্থাৎ দেশদ্রোহী। এবং এখন যুদ্ধ চলছে। তাই সিনিয়ার অফিসার হলেও সে বাবাকে কোনো সম্মান জানাতে পারছে না। ক্যাপ্টেন বাবাকে হুকুম করল, “তৈরি হয়ে নাও। আমাদের সাথে মার্শাল-ল হেড-কোয়ার্টারে তোমাকে যেতে হবে। পরিবারকে কিছু বলার থাকলে বলে নাও।”

বাবা মাকে বললেন, “নিজের ও বাচ্চাদের খেয়াল রেখো।”

তৈরি হয়ে বাবা ওদেরকে বলল, “চালো।” বাবার পিছন ও দুই পাশে তিন সৈনিক বন্দুক তাক করে তাকে নৌ-বাহিনীর একটি নীল জীপে উঠালেন। সবাই স্থির! আমি দৌড় দিয়ে দোতলায় উঠছি। কাচের জানালা দিয়ে বাবার দিকে তাকালাম। হাত উঠিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। তখনও ভাবিনি এই হবে শেষ দেখা।

এই দৃশ্য যে কত কষ্টের হতে পারে তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এই কষ্ট নিয়ে লেখক দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হঠাৎ ২০০৭-এর শেষে একটি সূত্রে দেহাবশেষের খোঁজ পান চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে। বুক ফাটা বেদনায় ওই মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার অবস্থা একজন সন্তানের। কারণ, ওই মাটিতেই তো আছে তার প্রাণপ্রিয় বাবা; আমাদের গর্ব কর্নেল কাদির। ওই মাটিতে মিশে গেলেও বাবার কাছে গিয়েছে সন্তান! ধরতে পেরেছে অদৃশ্য হাত।

হ্যাঁ, নাদীম কাদির তাঁর বাবার হাতটি ধরেছেন। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তাঁকে নিয়েছেন নাটোরে-- মহান শহীদের নামানুসারে রাখা নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসে। তার প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম। উল্লেখ্য, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ছাড়া আর কারো দেহাবশেষ স্থানান্তর করা হয়নি। প্রথমে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ এবং পরে কর্নেল কাদিরের দেহাবশেষ স্থানান্তর করা হয়।

বইটিতে প্রসঙ্গক্রমে জানতে পারি শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ জীবনের কথা। তার সাথে লেখকের দেখা এবং আদর করে টাকা হাতে দিয়ে পিতৃসুলভ মায়ায় সিক্ত হওয়ার সময়ের বয়ান। এবং স্বাধীনতার ঘোষণার সূত্রপাত। এই প্রসঙ্গে এখানে একটি জীবন্ত সাক্ষীর বক্তব্য লেখক তার বইয়ে দিয়েছেন। তাঁর নাম মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে কর্নেল কাদিরের সবচেয়ে স্নেহের ও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার একটি বক্তব্য উল্লেখ করার মতো—“কর্নেল কাদির যদি সময় মতো বের হতে পারতেন তবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা উনি পাঠ করতেন। উনি না আসতে পারায় তখন মেজর জিয়াকে দিয়ে ঘোষণা পাঠ করানো হয়। মেজর জিয়া থেকে সিনিয়র ছিলেন কর্নেল কাদির। এদিকে, পাক সেনারা বিস্ফোরক পাচারের কথা জানতে পেরে তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।

সবশেষে বলি সহজ ভাষায় লেখা “মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায়’’ বইটি মুক্তিযুদ্ধ গবেষকসহ অনুসন্ধানী পাঠকের কাজে লাগবে। সুপাঠ্য গ্রন্থটি সংগ্রহযোগ্য।

 

ইমরান মাহফুজ: কবি, গবেষক ও সম্পাদক কালের ধ্বনি। সমন্বয়কারী ডেইলি স্টার বুকস।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

5h ago