‘ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ’ ইহা ওনারা বুঝিয়াও বুঝিলেন না
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/rape_2_0.jpg?itok=8mwtTduU×tamp=1522912543)
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নায়িকা পূর্ণিমা ও খলনায়ক মিশা সওদাগরের ধর্ষণ বিষয়ক আলাপচারিতা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকে এই অনুষ্ঠানের লিংকটা ছড়িয়ে পড়েছে। যিনিই দেখছেন, তিনিই বিস্মিত হচ্ছেন, ছি ছি করে উঠছেন। মানুষ বুঝতেই পারছে না একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এই বিষয়ে একটি রসাত্মক আলোচনা, ঠিক এরকম একটি সময়ে কিভাবে হতে পারে, যখন দেশজুড়ে ধর্ষণের ভয়াবহতা মারাত্মক রূপ নিয়েছে।
নায়িকা পূর্ণিমা উপস্থাপিকা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম কুড়ানোর পর পরই এমন একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করলেন, যেখানে তিনি কথা বলেছেন ধর্ষণ নিয়ে ঢাকাই সিনেমার একজন খলনায়কের সাথে। এতে অপরাধের কিছু ছিল না, যদি তাদের আলোচনাটি হতো গঠনমূলক। সিনেমায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ধর্ষণ দৃশ্য চাপিয়ে দেওয়া হয় যৌন নিপীড়নের একটি অস্ত্র হিসেবে। এটি কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়, এটি একটি অপরাধ। তারা চাইলেই এর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারতেন। কথা বলতে পারতেন এর পরিবর্তনের পক্ষে।
যাহোক তীব্র সমালোচনার মুখে নায়িকা পূর্ণিমা এই অনুষ্ঠানের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন ঠিকই কিন্তু নিঃশর্ত ক্ষমা চাননি। এক কোণা দিয়ে তিনি সাধারণ দর্শকদের উপর দোষটা চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “সাধারণ মানুষ হয়তো এতকিছু বুঝতে চাইবেন না তাদের ভাববারও সময় নেই। আমরা আসলে অনেককিছুই সহজভাবে নিতে পারিনা একটু শুনেই ঝাঁপিয়ে পড়ি। বোঝার চেষ্টা করি না এটা একটা ফান শো বা চলচ্চিত্রের দুটো মানুষের আড্ডা।” পূর্ণিমা বলেছেন ব্যক্তিগত রেষারেষি থেকে পুরো অনুষ্ঠানের ওই অংশটি কেটে ভিডিওটা ছড়ানো হয়েছে। কারা করেছে এটা উনি বলেননি।
তার মানে পূর্ণিমা এখনো মনে করেন মিশা সওদাগরকে করা তার প্রশ্নগুলো কোনভাবেই অশ্লীল নয়। প্রশ্নগুলো ছিল—“আপনি সিনেমাতে কতবার ধর্ষণ করেছেন? প্রতিটা ছবিতেই কি ধর্ষণের দৃশ্য ছিল? ধর্ষণ করতে কার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন?” এর উত্তরে মিশা সওদাগর মৌসুমী ও পূর্ণিমার কথা বলাতে উপস্থাপিকা হেসে গড়িয়ে পড়েন। যেন ধর্ষিত হওয়াটা বড় আনন্দের একটি বিষয়। পূর্ণিমা মিশাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, “কেন আমরা দু’জনই কেন?” এরকম প্রশ্ন-উত্তর যে কোনো সুস্থ ব্যাপার নয়, তা তিনি মনেই করেন না। উপরন্তু পূর্ণিমা বলেছেন, মানুষ বুঝতে ভুল করেছে। আর অনুষ্ঠানের এই অংশটুকু কেউ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দিয়েছে।
শুধু পূর্ণিমা নয়, অনুষ্ঠানের প্রযোজকও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল। সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। তবে তিনি বলেছেন, একটা ভুলের জন্য চারিদিকে যা চলছে, তাতেই তিনি মর্মাহত।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে অনুষ্ঠানটি প্রচারের আগে ওই অনুষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই মনে হয়নি পূর্ণিমা ও মিশা সওদাগরের মধ্যে পর্দায় ধর্ষণ দৃশ্য নিয়ে এই আলোচনা কতটা বাজে ইঙ্গিত বহন করছে। ঢাকাই সিনেমা, টালিউড বা বোম্বাইয়ের সিনেমাতে ধর্ষণের দৃশ্য এতটাই স্বাভাবিক যে সিনেমার নায়িকা এবং ভিলেন কেউই মনে করেননি যে ধর্ষণ নিয়ে এসব ভাঁড়ামিপূর্ণ কথাগুলো অত্যন্ত অশ্রাব্য। শুধু কি ওনারা? বুঝতে পারেনি এই অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত প্রযোজক, সংলাপ রচয়িতা, এডিটর, কলা-কুশলী। প্রত্যেকের কাছে এগুলো খুব সহজ ও মজার সংলাপ।
মিশা সওদাগর মনে করেন এটা, মানে ধর্ষণের এই আলোচনা নিয়ে কোনো বিতর্কই হতে পারে না। তার ভাষায়, “বেচারি পূর্ণিমা একটা প্রশ্ন করেছে আমি উত্তর দিয়েছি। সেটাতো পাণ্ডুলিপিতেই ছিল। আমরা চলচ্চিত্রে ধর্ষণের যে অভিনয় করি, সেটাও পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী করি। ইচ্ছা করে তো আর করি না।” মিশার পক্ষে এই কথা বলা খুবই স্বাভাবিক। কারণ তাদের কর্মক্ষেত্রে যৌন অপরাধকে “আনন্দ” এর উৎস বলে মনে করা হয়। মনে করা হয় বাজে কথা ও কাজ, অশ্লীল গালিগালাজ, ধর্ষণ দৃশ্য, নায়িকার বা পার্শ্ব নায়িকার নগ্ন নাচ গান সবই পাণ্ডুলিপির অংশ।
চলচ্চিত্রে খলনায়কতো খলনায়ক, আমাদের নায়করা পর্যন্ত নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে যে অঙ্গভঙ্গি করে, কথা বলে, শিস দেয় তা সবই যৌন নিপীড়নের পর্যায়ে পড়ে। বহুবার বহুজন বাংলাদেশি সিনেমার এই ক্রম অধঃপতন নিয়ে কথা বলেছেন, লিখেছেন, আলোচনা করেছেন। কিন্তু অবস্থা তথৈবচ। বরং দিনে দিনে দর্শকের ঘাড়ে এইসব কুরুচিপূর্ণ সিনেমা চেপে বসেছে। চেপে বসতে বসতে এখন টিভি অনুষ্ঠানেও ঢুকে পড়েছে অবলীলায়।
যারা একবার ধর্ষণ দৃশ্য সম্বলিত কোনো বাংলা সিনেমা দেখেছেন, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন ছায়াছবিতে ধর্ষণ যেভাবে, যতবার উপস্থাপিত হয়, সেগুলো কোনোটাই কাহিনীর প্রয়োজনে নয়। ধর্ষণ দেখাবে বলেই চিত্রনাট্য লেখা হয়। দেখানো হয় বিনোদন উপকরণ হিসেবে। আর এই বিনোদনের ব্যাপারটা পূর্ণিমার মতো জনপ্রিয় নায়িকাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেওয়া হলো।
সাধারণ মানুষ যারা বাংলা সিনেমা বুঁদ হয়ে দেখেন, তারা সিনেমার প্রতিটা বিষয়কেই সত্য বলে ধরে নেয়। এদেরকে অনুসরণ করতে চায়। তাদের ফ্যাশনকে ফলো করে। নায়ক-নায়িকা-ভিলেন যা যা করে, সবকিছু তারা মনোযোগ দিয়ে দেখে। নায়ক যখন নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে নানা অপ্রিয় আচার-আচরণ করে, কোনো দৃশ্যে নায়িকাকে দেখানোর পর উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে “ডাব” ও “দুধেল গাভী’ দেখানো হয়, সুস্থ চুম্বন দৃশ্য না দেখিয়ে “দুটি জবা ফুলকে দলিত মথিত” করে দেখানো হয়, যখন কারণে অকারণে ধর্ষণ দৃশ্য দেখানো হয়, তখন আমাদের সেন্সর বোর্ড মনে করে না এসব অশ্লীল। আর দর্শকদের অনেকেই ধরে নেয় এসব করাই যায়, খুব স্বাভাবিক।
আমার ধারণা, না ধারণা নয়, আমি নিশ্চিত যে, নায়িকা পূর্ণিমা যখন ধর্ষণ বিষয়ক আলোচনা করে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলেন, তখন হয়তো উনি জানতেনই না যে এদেশে চলতি বছরের প্রথম তিনমাসে ১৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন দুই জন। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ২১ জনের উপর। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৭ জন নারী।
আরও ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৭২ জন শিশু, এরমধ্যে মারা গেছে ১৮ জন। আহত হয়েছে ৪৫৪ জন শিশু। বয়স্ক নারী থেকে এক বছরের শিশু কেউ রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকামীদের হাত থেকে। দিনে দিনে এর ভয়াবহতা বাড়ছে যে, তা মানুষের সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। ঠিক এরকম একটি পরিস্থিতিতে যখন জাতীয় প্রচার মাধ্যমে কোনো জনপ্রিয় নায়িকা ও সিনেমার খলনায়ক ধর্ষণ করতে কেমন মজা এ জাতীয় আলোচনা করেন, তখন সচেতন মানুষ ক্ষুব্ধ হবেন, আর এটাই হওয়া উচিৎ। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র নেই।
বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রের নায়ক নায়িকারা যখন ভালো ভালো কাজের জন্য বা বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে পথে নামছেন, আন্দোলন করছেন, টিভি অনুষ্ঠান বা সেলেব্রিটি শো করছেন, তখন আমাদের নায়িকা টিভি চ্যানেলে এসে ধর্ষণকে বৈধতা দিচ্ছেন। অথচ তারা যদি কিছুটা সচেতন হতেন, তাহলে এই আলোচনার প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করতেন ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির কাজে। প্রতিবাদ জানিয়ে বলতেন, না আর ধর্ষণের দৃশ্যে এভাবে আমাদের ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু না তাদের এই বোধটুকুও কাজ করেনি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম একটি অনলাইন গণমাধ্যমকে বলেছেন, “ধর্ষণ বিষয়টি আমরা সেক্সুলাইজ করছি, কিন্তু এটাকে ক্রিমিনাইলজ করার কথা। সেক্সুয়াল সিম্বলটাকে নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাকে মানুষ হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে না। এটা কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।” আমাদের সমাজে ঠিক তাই ঘটছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় গণমাধ্যম সিনেমাতে ধর্ষণ এসেছে যৌন অপরাধকে উস্কে দিতে। আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো আমাদের নায়ক-নায়িকা-কলা-কুশলীরা একে, মানে ধর্ষণের মত অপরাধকে গণনার মধ্যেও আনছেন না।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ কর্মী
Comments