খুলনায় কী ঘটলো, একটি পর্যালোচনা

‘বিচ্ছিন্ন’ শব্দটির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শব্দটি ব্যবহৃত হলো। ‘বিচ্ছিন্ন’ শব্দটি ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন বলেছে, ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র তিনটি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত ‘সন্তুষ্ট’। বিজয়ী আওয়ামী লীগ খুশি, বিএনপির বিস্তর অভিযোগ এবং নির্বাচন কমিশনের ‘সন্তুষ্টি’র আড়ালে খুলনাবাসী ভোটারদের মনোভাব কী?
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক (বামে) ও বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু (ডানে)। ছবি: আমরান হোসেন

‘বিচ্ছিন্ন’ শব্দটির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শব্দটি ব্যবহৃত হলো। ‘বিচ্ছিন্ন’ শব্দটি ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন বলেছে, ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র তিনটি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছিল। তিনটি কেন্দ্রেরই ভোটগ্রহণ স্থগিত করেছে, নির্বাচন কমিশন। এছাড়া আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে, তা খুব উল্লেখযোগ্য কিছু না। অল্প কয়েকটি ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা ছাড়া নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত ‘সন্তুষ্ট’। বিজয়ী আওয়ামী লীগ খুশি, বিএনপির বিস্তর অভিযোগ এবং নির্বাচন কমিশনের ‘সন্তুষ্টি’র আড়ালে খুলনাবাসী ভোটারদের মনোভাব কী?

খুলনার নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা।

 

১. প্রথমে আসি বিএনপির অভিযোগ প্রসঙ্গে। নির্বাচনে নিজের ভোট দিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বললেন, ৩০টি কেন্দ্র থেকে তার পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। তারপর পর্যায়ক্রমে অভিযোগ এসেছে বিএনপির পক্ষ থেকে, কেন্দ্র দখল-জাল ভোট দেওয়া হচ্ছে। ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বিএনপির প্রার্থী এসব অভিযোগ খুলনায় করেছেন, ঢাকায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেও এসব অভিযোগ করেছেন।

গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিনের খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করেছি। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। বিএনপির অভিযোগ বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার মনে করছি।

ক. ‘৩০টি কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে’- বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু অভিযোগ করেই দায়িত্ব শেষ করেছেন। তার আরও কিছু করণীয় ছিল, সেদিকে যাননি। ৩০টির মধ্যে চার পাঁচটি কেন্দ্রের নাম বলেছেন, সুনির্দিষ্ট করে ৩০টি কেন্দ্রের নাম বলেননি বা বলতে পারেননি।

খ. ৩০টি কেন্দ্রে কারা পোলিং এজেন্ট ছিলেন, তাদের নাম এবং কাকে কখন বের করে দেওয়া হয়েছে- কিভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি বা বলতে পারেননি।

২. পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু এককভাবে নির্বাচন করছেন। তাকে কেউ সহযোগিতা করছেন, তেমন কাউকে নির্বাচনের মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর রায়কে সমন্বয়কারী করা হয়েছিল। তার উপস্থিতি দৃশ্যমান ছিল না। তিনি আদৌ সমন্বয়ের কিছু করেছেন বলে মনে হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী এলাকার বাইরের কারও পক্ষে শেষ সময় পর্যন্ত সমন্বয় করাও সম্ভব না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল স্থানীয় কোনো নেতাকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে তা করা হয়নি। ফলে সমন্বয়হীনতা প্রকট হয়ে উঠেছিল।

নজরুল ইসলাম মঞ্জুর নির্বাচনী সমন্বয়কারী কোথায় থাকলেন, কী করলেন- তা গণমাধ্যম বা বিএনপি নেতা- কর্মীরা বুঝতে পারেননি।

২০১৩ সালের নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র মনিরুজ্জামান মনিকে মনোনয়ন কেন বিএনপি দিলো না, তা ভোটার বা কর্মী- সমর্থকদের বোঝাতে পারেনি। মনি মেয়র নির্বাচিত হয়ে নিপীড়ন- নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিএনপি কর্মী- সমর্থকদের একটা সহানুভূতি ছিল তার প্রতি। মনি ও তার সমর্থকরা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি। মনি নীরব থেকেছেন। তার অনুসারী অনেকে ভেতরে ভেতরে তালুকদার আবদুল খালেকের পক্ষে কাজ করেছেন।

কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিএনপির দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল, যারা মেয়রের পক্ষে কাজ করেননি। দলীয় মনোনয়ন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীরা মেয়র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি।

দুপুরের আগে পর্যন্ত ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে চলছিল। প্রথমে ভোটগ্রহণের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। অনিয়মের দৃশ্য দুপুর থেকে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।

৩. প্রচলিত ধারায় কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই-জাতীয় যা  ঘটে, খুলনার ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি। কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা জড়ো হয়েছে। সর্বত্র একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।

ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। দশ পনেরোজন হুটহাট কেন্দ্রে ঢুকে ‘সিল মেরে’ ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে আবার বেরিয়ে এসেছে। কেন্দ্র একনাগারে দখল করে রাখেনি। কেন্দ্রের সামনে বিএনপি নেতাকর্মীরা ছিল না বা তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বা ভয়ে চলে গেছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টের সামনেই এসব ঘটেছে, কোনো কোনো কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্ট ছিল না। আগেই তাদের বের করে দেওয়া হয়েছিল, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিল, কেউ কেউ কেন্দ্রে আসেইনি।

৪. বিএনপির পোলিং এজেন্টদের একটা অংশ ‘সমঝোতা’ করে ফেলেছিল। সকালে নজরুল ইসলাম মঞ্জু যে ৩০টি কেন্দ্র বিষয়ে অভিযোগ করেছেন সে সবের কমপক্ষে ১০টি কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্ট আসেইনি। না এসে বলেছে, ‘যেতে দেওয়া হয়নি’ ‘মারধর করে’ বের করে দেওয়া হয়েছে। ভয় এবং মারধর কাউকে কাউকে করা হয়েছে, তা সত্য। কিন্তু এদের অনেকে যে ‘সমঝোতা’র বিনিময়ে আসেনি বা পক্ষ ত্যাগ করেছে সে বিষয়ে বিএনপি মোটেই সচেতন ছিল না। বিএনপি নির্বাচন করেছে অত্যন্ত অগোছালোভাবে। খুলনা বিএনপিই চায়নি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু বিজয়ী হোক। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও ঢাকায় বসে মুখস্থ অভিযোগ করেছে। খুলনা নির্বাচনের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল, সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য থেকে তা বোঝা যায়নি। খুলনায় কী ঘটছে, প্রকৃত চিত্র তারা জানতে পারছিলেন বলে মনে হয়নি।

৫. বিএনপির সক্রিয় নেতাদের নামে একাধিক মামলা আছে। প্রায় সবই রাজনৈতিক মামলা। তফসিল ঘোষণার পর ‘সুনির্দিষ্ট মামলার আসামি’ গ্রেপ্তারে বাধা নেই। আইনের এই সুযোগে নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে থেকে নির্বাচনের আগের রাত পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘আসামি’ ধরার অভিযান চালিয়েছে। সক্রিয় নেতাদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে নির্বাচনের কাজে অংশ না নিয়ে লুকিয়েছেন।

আশেপাশের জেলা থেকে বিএনপির যেসব নেতা নির্বাচনে কাজ করার জন্যে খুলনায় এসেছিলেন, তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।

এক এক দিন কতজনকে, মোট কত জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, কাদেরকে গ্রেপ্তার করেছে- এসব কোনো তথ্য বিএনপির স্থানীয় নেতৃত্ব বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি। এক্ষেত্রেও তারা শত শত গ্রেপ্তার’র মুখস্থ অভিযোগই করেছেন।

নির্বাচনের আগে এসব গ্রেপ্তার ও নির্বাচনের দিনের অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তারা নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিতভাবে তুলে ধরতে পারেনি। তুলে ধরলেই যে পরিস্থিতির খুব বেশি কোনো পরিবর্তন হয়ে যেত, তা নয়। নির্বাচন কমিশনকে কিছুটা চাপে রাখতে পারত। নির্বাচন কমিশনকে অন্তত কিছু কথা বলতে হতো। ‘খুব ভালো নির্বাচন হয়েছে’- নির্বাচন কমিশনের এমন কথা বলতে হয়ত একটু দ্বিধায় পড়তে হতো। পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিএনপি পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে যে, তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। মাঝ পথে মাঠ ছাড়ার ঘোষণা দেয়নি। এতে নির্বাচনে পরাজিত হলেও, পাবলিক পারসেপশনে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তৈরিতে সক্ষম হয়েছে।

৬. জামায়াতের ভোটও পুরোপুরি ভাবে পক্ষে নিতে পারেনি বিএনপি। বিশেষ করে বাগের হাট-৩ রামপাল- মোংলা আসনে জামাতের অবস্থান শক্তিশালী। এটা তালুকদার আবদুল খালেকের আসন। এই আসনে জামায়াত সব সময় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তালুকদার আবদুল খালেক এই আসনে নির্বাচন না করলে, জামায়াতের সুবিধা হয়। নেপথ্যে জামায়াতের সঙ্গে তালুকদার আবদুল খালেকের এই কেন্দ্রীক একটা সমঝোতা হয়েছে বলে জানা যায়। ফলে জামায়াতের ভোট মঞ্জু পাননি, পেয়েছেন খালেক।

৭. আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সব রকমের সহায়তা তো পেয়েছেই, দলীয়ভাবেও একত্রিত হয়ে কাজ করেছে। আশপাশের জেলার সকল নেতা একত্রিত হয়ে কাজ করেছেন। তালুকদার আবদুল খালেকের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী এস এম কামাল নিবেদিত হয়ে কাজ করেছেন। কর্মীদের সংগঠিত করা, ভোট কেন্দ্রের সামনে জমায়েত, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ভোটারদের ভয়- ভীতি প্রদর্শন, সবই করেছে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী।

৮. গণমাধ্যম নির্বাচনে অনিয়মের অনেক চিত্র দেখিয়েছে। বিএনপির অভিযোগ সুনির্দিষ্ট হলে আরও অনেক চিত্র গণমাধ্যমকে হয়ত দেখাতে হতো। অনিয়মের চিত্র দেখানোর পাশাপাশি অধিকাংশ গণমাধ্যম অনিয়মগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিএনপির অভিযোগ সুনির্দিষ্ট হলে, সেটা হয়ত হতো না।

শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র ভয়ঙ্কর সঙ্কটের মুখে পড়েছে। ভারতের নির্বাচন বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সরকার- জাতীয়, সব নির্বাচন বড় রকমের প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়াতে আবার অসাধারণ একটি নির্বাচন হয়ে গেল। শ্রীলঙ্কা, নেপালে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

খুলনার নির্বাচনটির মধ্য দিয়ে বোঝা গেল, বাংলাদেশে ‘সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন দেখার জন্যে জনগণকে আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে। ‘সন্তুষ্ট’ মানসিকতার নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, বিশ্বাস করা কঠিন। ‘লিখিত অভিযোগ’ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, নিজেরা কিছু করবে না- এই প্রক্রিয়ায় আমলাতন্ত্র চললেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায় না। তার চেয়ে বড় বিষয় সুষ্ঠু নির্বাচন করা দরকার, নির্বাচন কমিশনের কাছে তা খুব একটা প্রয়োজনীয় বিষয় বলেও মনে হয় না।

Comments

The Daily Star  | English
government changed office hours

Govt office hours 9am-3pm from Sunday to Tuesday

The government offices will be open from 9:00am to 3:00pm for the next three days -- from Sunday to Tuesday -- this week, Public Administration Minister Farhad Hossain said today

2h ago