নগরীতে ‘সুপার সিএনজি’!

পরিবারের অনেক সদস্যই তপনকে ‘পাগল’ বলে আখ্যা দেন। আবার অনেকের কাছে তিনিই ‘অগ্রদূত’। কিন্তু, সেই তপনের কাছে বিষয়টি তাঁর দীর্ঘদিনের ইচ্ছাপূরণ মাত্র।
আর অনেকের মতো তপন একজন সিএনজি-চালিত অটোরিকশা চালক। তবে আর সবার থেকে ব্যতিক্রম তিনি। কেননা, তিনি তাঁর অটোরিকশাটি এমনভাবে সাজিয়েছেন যা এ শহরে এমনটি আগে কেউ দেখেননি- তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
প্রায় ১০ বছর ধরে অটোরিকশা চালাচ্ছেন তপন। গত চার মাসে তিনি সাজিয়েছেন তাঁর অটোরিকশাটি। এই সাজ-সজ্জাই ব্যতিক্রম করে তুলেছে তপন ও তাঁর অটোরিকশাটিকে।
কী রয়েছে তপনের এই ‘বিশেষ অটোরিকশায়’ যাতে চড়লে একজন যাত্রীর অন্যরকম অনুভূতি হবে? জেনে অবাক হবেন, প্রযুক্তির এই যুগে যখন যোগাযোগ একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয় তখন তপনের অটোরিকশাতেই মিলবে ওয়াইফাই।
শুধু তাই নয়, ফিলটারের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। রয়েছে টেলিভিশন। সেই টেলিভিশনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি সিনেমার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও, পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে।
যাত্রীদের জন্যে একটি আয়নাও রাখা হয়েছে অটোরিকশাটিতে। তাঁদের সাজগোজের জন্যে রয়েছে চিরুনি, ফেসিয়াল টিস্যু, নখ পরিষ্কারের যন্ত্র। রয়েছে মোবাইল ফোন চার্জার, ফ্যান, ডিজিটাল ঘড়ি, সাউন্ডবক্স।
এছাড়াও, নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে রয়েছে আগুন নেভানোর যন্ত্র এবং সিসিটিভি।
এ তো গেলো অটোরিকশার ভেতরের সুযোগ-সুবিধা। এর বাইরের চিত্রটিও চমকপ্রদ। অটোরিকশাটির ছাদে রয়েছে আকর্ষণীয় বাগান। সেই বাগানে মিলবে দেশি-বিদেশি গাছ।
তপনের বক্তব্য, “এর ফলে গাড়িটাকে দেখতে যেমন সুন্দর দেখায়, তেমনি গাড়ির ভেতরটাও ঠাণ্ডা রাখে।”
পঞ্চাশ বছর বয়সী এই অটোরিকশা চালকের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিলো তাঁর গাড়িটিকে সাজানোর। তবে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে সম্প্রতি। “যাত্রীদের উন্নত সেবা দিয়ে তাঁদেরকে মুগ্ধ করার চিন্তাটা আমার অনেকদিনের।”
কিন্তু, মজার বিষয় হলো, যে অটোরিকশাটিকে এতো কষ্ট করে বা এতো টাকা খরচ করে তিনি সাজিয়েছেন সেটির মালিক তিনি নন। তিনি খিলগাঁওয়ের একজন গ্যারেজ মালিক আফতাবউদ্দিনের কাছে থেকে ভাড়া নিয়েছেন এটি।
“মালিককে বললাম, আমি গাড়িটা সাজাতে চাই। তিনি তা শুনে রাজি হলেন। তাঁকে বললাম খরচ আমিই করবো,” যোগ করেন তপন।
অটোরিকশাটি সাজাতে তপনের খরচ হয়েছিল প্রায় ৪০,০০০ টাকা। কিন্তু, এ জন্যে তিনি যাত্রীদের কাছে থেকে কোনোরকমের বাড়তি ভাড়া নেননি। “যাত্রীদের কেউ কেউ খুশি হয়ে বখশিশ দেন, সেই টাকাও খরচ করি সাজ-গোজের পেছনে” স্মিত হাসি মুখে নিয়ে বলেন তপন। অন্যান্য সিএনজি-চালিত অটোরিকশা চালকের মতোই তপন ঘরে আনেন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা।
কিন্তু, এসবের রক্ষণাবেক্ষণে বেশ বাড়তি টাকা খরচ করতে হয় তাঁকে। প্রতিদিন ৯০০ টাকা মালিককে জমা দেওয়ার পর যে টাকা থাকে তা দিয়ে তিনি এই খরচ মেটান। তপন জানান, এ জন্যে তাঁকে প্রতিমাসে আড়াই হাজার টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়। এই খরচের মধ্যে রয়েছে ওয়াইফাইয়ের দাম, বাগান রক্ষণাবেক্ষণ এবং তিনটি পত্রিকা রাখার খরচ।
বর্তমানে খিলগাঁওয়ের অধিবাসী তপনের আদি বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তাঁর এই আবেগ বা ভালোলাগার বিষয়টিকে পরিবারের কেউই সমর্থন করেননি।
“আমি লোকজনদের সেবা দিতে চাই। আমি চাই আমার সিএনজিতে উঠে একজন যাত্রী নতুন অভিজ্ঞতা নিক,” তপন বলেন, “অনেক সময় গাড়িতে উঠে অনেক যাত্রী অবাক হয়ে যান। কেউ আবার প্রশ্নও করেন, কেনো এমনভাবে সাজিয়েছি। কিন্তু, এই সেবায় যদি একজনও খুশি হন তাহলেই আমার শ্রম সার্থক।”
তপন প্রতিদিন সকাল আটটায় তাঁর অটোরিকশা রাস্তায় বের করেন আর ঘরে ফিরেন রাত সাড়ে নয়টার দিকে। রাতে তপনের অটোরিকশা দেয় নতুন আনন্দ। স্বপ্নিল আলোর দ্যুতি ছড়ায় গাড়ির ভেতরে ও বাইরে- গাড়ির ছাদ-বাগানে।
তবে এতেই থেমে নেই তপন। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেন, “প্রয়োজন হলে আরও নতুন নতুন সেবা যোগ করবো।”
Comments