খাদ্যে ভেজাল-বিষ মানদণ্ডে, বাংলাদেশ কী পৃথিবীতে শীর্ষে?

বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ফল পাকানোর কথা, বাংলাদেশের সব মানুষই কম বেশি জানেন। অফিসে একজন বলছিলেন, বেল ছাড়া কোনো ফলই খাওয়ার উপায় নেই। সবই বিষ মিশ্রিত, ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর!
খাদ্যে ভেজাল

বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ফল পাকানোর কথা, বাংলাদেশের সব মানুষই কম বেশি জানেন। অফিসে একজন বলছিলেন, বেল ছাড়া কোনো ফলই খাওয়ার উপায় নেই। সবই বিষ মিশ্রিত, ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর!

বললাম, দেশীয় ফলের মধ্যে আনারসে বিষ মেশানো হয় না। আনারস খাওয়া যায়। দেশে এখন আনারস আবাদের পরিমাণ এত বেড়েছে যে, বিষ দিয়ে পাকানোর প্রয়োজন হয় না। আনারসেও বিষ মেশানো হয়, আলোচনায় সে কথা সবাই বললেন। একমত হতে পারলাম না। ধারণা ছিল, আনারস এবং তরমুজে কোনো বিষ মেশানো হয় না।

গত দু’ সপ্তাহে দুবার ‘একটি কুড়ি দুটি পাতার দেশ শ্রীমঙ্গল গিয়েছিলাম। বর্ষার চা বাগান আর প্রকৃতির আকর্ষণে। শ্রীমঙ্গলে ঢোকার আগে থেকেই রাস্তার দুপাশে আনারস নিয়ে বসে আছেন খুচরা বিক্রেতারা। গাছ পাকা বা খেত পাকা আনারস। মাত্র বাগান থেকে আনা হচ্ছে, টকটকে রঙিন আনারস। পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু এই আনারস ৩০ বা ৪০ টাকা হালি। দামাদামি করলে আরও কমে কেনা যায়।

পরের সকালে বের হয়েছি। সেই রকম বৃষ্টি, যে রকম বৃষ্টি ঢাকার শহরে অনুধাবন করা যায় না। এর মধ্যে ছোট ছোট ঠেলা গাড়ি ভর্তি আনারস, কাঁঠাল, লিচু নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছেন। এসব ঠেলা চালকরা বিক্রি করতে পারেন না।

আনারস বাগান কোথায়?- প্রশ্নের উত্তরে ‘এই দিক দিয়ে, ওই দিকে যান। কিন্তু বাগানের আনারস তো কাঁচা। এখন সিজন শুরু হয়নি। বাগানে গিয়ে পাবেন না।’

এগুলো কি পাকা না?

‘এগুলো তো বিষ দিয়ে পাকানো।’

গতকাল রাস্তা থেকে কিনেছিলাম, সেগুলো তো পাকা ছিল।

‘সব বিষ দিয়ে পাকানো। আনারস পাকার সময় হয় নাই এখনও।’

কাঁঠাল নিয়ে যাওয়া ঠেলাওয়ালারা জানালেন, এগুলো ভালো না। ‘ঘাই’ দিয়ে পাকানো। ‘ঘাই’ মানে পেরেক জাতীয় কিছু একটা দিয়ে বোটার দিক  ফুটো করে বিষ দিয়ে পাকানো।

বাগান থেকে কাঁঠাল এনে রাস্তায় জড়ো করা হচ্ছে। তারাও স্বীকার করলেন ‘ঘাই’ দিয়ে পাকানো। বেছে দু’টি কাঁঠাল দিয়ে বললেন ‘ভালো আছে’ নিয়ে যান। দাম মাত্র ১০০ টাকা। কাঁচা একটি কাঁঠাল দিলেন, টাকা নিলেন না। রেস্ট হাউজে এনে দেখা গেল, নরম পাকা কাঁঠালের কোষগুলো সাদা, মিষ্টি তো নয়ই- খাবার অনুপযোগী স্বাদ। কাঁচা কাঁঠালকে ‘ঘাই’ দিয়ে পাকানো হয়েছে।

আনারস বাগানে গিয়ে দেখি, সত্যি সত্যি বাগানভর্তি কাঁচা আনারস। একটি আনারসও পাকেনি। বৃষ্টির সকালে, বাগানে কেউ নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একজনকে পাওয়া গেল। তিনি স্থানীয়, বাগানের কেউ নন। জানালেন, আনারস পাকতে আরও ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগবে। বিষ দিয়ে পাকানোর বিষয়টি তিনিও নিশ্চিত করলেন।

কৌতূহলবশত দুটি কাঁচা আনারস বাগান থেকে সংগ্রহ করলাম। কাটার পর দেখা গেল সবুজ আনারসের ভেতরটা প্রায় সাদা, কিন্তু খেতে সুস্বাদু। আর কয়েকদিন পর পাকলে, বাইরে-ভেতরে রঙ এবং স্বাদ দুটোই পরিপূর্ণ হবে।

অপূর্ণ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক কাঁঠাল-আনারস পাকানোর এমন ঘটনা জেনে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল।

 

২. আনারস শুরু থেকে পাকা পর্যন্ত ৩ মাস সময় লাগে। বেশি লাভের লোভে, দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে আনারস পাকানোর ব্যবস্থা করা হয়। একটু অনুসন্ধান করতে গিয়েই বিষয়টি জানলাম। আনারসের ফুল আসার সঙ্গে সঙ্গে সুপারফিক্স নামক একটি হরমোন স্প্রে করা হয়। যার ফলে অতি দ্রুত বড় হয়। অপরিণত আনারস ফুলেফেঁপে বড় হয়ে ওঠে। মাস দেড়েক পরে মানে প্রাকৃতিক নিয়মে পাকার মাস দেড়েক আগে, বিষাক্ত রাইপেন- ইথোফেন স্প্রে করা হয়। স্প্রে করার এক থেকে তিন দিনের মধ্যে বাগানের সব আনারস এক সঙ্গে পেকে টকটকে রঙ ধারণ করে। তারপর স্প্রে করা হয় ফরমালিন। যা আনারসকে পচন থেকে রক্ষা করে। ফরমালিন স্প্রের পরের দিন বাগানের সব আনারস তোলা হয়। পাইকাররা কিনে বাজারে নিয়ে আসেন।

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঁচা আনারস বাগান থেকে তুলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড স্প্রে করে পাকানো হয়। পচন ঠেকানোর জন্যে দেওয়া হয় ফরমালিন।

৩. মৌসুম শুরু হওয়ার আগে কাঁঠালের দাম বেশি পাওয়া যায়। শ্রীমঙ্গলের স্থানীয় ভাষায় ‘ঘাই’ দিয়ে পাকানোর কথা, উপরে লিখেছি।

রোজার সময়ের আরেকটি অপরিহার্য ফল কলা। বাংলাদেশে সবরি- চাপা- সাগর কলা উৎপাদন হয়। সময়ের আগে কলায় বিশেষ করে সবরি কলায় হরমোন স্প্রে করা হয়। অপরিণত কলা কেরোসিনের স্টোভের হিট দিয়ে নরম করা হয়। রাইপেন- ইথোফেন বা কার্বাইড স্প্রে করে পাকানো হয়। স্প্রে করার আগে কলা পরিষ্কার করা হয় সার্ফএক্সেল বা শ্যাম্পু দিয়ে। পাকানোর এই বিষাক্ত পদ্ধতি বাদামতলি থেকে কারওয়ানবাজার এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলার আড়তে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। বিষাক্ত কলা বাজার থেকে কিনে খায় মানুষ।

ঈশ্বরদীর লিচু বাগান, যেকোনো মানুষের চোখ জুড়িয়ে দেয়। লিচু বাগানে গেলে, আকার- পরিমাণ দেখে বিস্মিত হতে হয়। সেই লিচুতেও পাঁচ থেকে ছয়বার কীটনাশক স্প্রে করা হয়। ঝড়ে না পড়া, বোটা শক্ত, বৃদ্ধি, রঙ চকচকে করাসহ সব কিছুর জন্য বিষ দেওয়া হয়।

কাঁচা পেঁপে পাকানো হয়, রাইপেন- ইথোফেন স্প্রে করে। বাইরের আবরণ দেখে মনে হয় পাকা। আসলে কাঁচা। পেঁপে বিষ দিয়ে পাকানোয় খাওয়ার অনুপযুক্ত থাকে। কোনোটা খাওয়া গেলেও তাতে, পেঁপের স্বাভাবিক পুষ্টিগুণ থাকে না। এসব পাকা পেঁপেতে বিষ জাতীয় যা থাকে তা মানব দেহের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর।

সবচেয়ে সুস্বাদু ফল আম। আরও এক মাস আগে থেকে বাজারে আম উঠেছে। এসবই কাঁচা অপরিণত আম, বিষ দিয়ে পাকানো।

মাছে ফরমালিন। সবজিসহ সবকিছুতেই বিষ।

৪. সত্যি, বাজারে বেল ছাড়া আর কোনো ফল দেখছি না, যা পাকানোর ক্ষেত্রে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়নি। কী এক ভয়ঙ্কর দেশের মানুষ আমরা। আমাদের সব ফল, ভয়ঙ্কর বিষ মেশানো। প্রকৃতি নয়, বিষ মিশিয়ে আপনাকে খাওয়াচ্ছে মানুষ। একেবারে সাধারণ চাষি থেকে ছোট- বড় ব্যবসায়ী, সবাই এমন অন্যায়- অনৈতিক কাজ করছেন। লিচু বা আম বাগানগুলো মুকুল আসার আগে- পরে বড় ব্যবসায়ী, সুপার শপগুলো কিনে নেয়। বিষ মেশানোর অপকর্ম তারাও করে। কারও বিবেক স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। মুনাফাই তাদের কাছে শেষ কথা, মানুষের জীবন নয়।

ফলে যে বিষ দেওয়া হয়, তা একবারে পরিমাণ মত খেলে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ মারা যায়। চাষি বা ব্যবসায়ীরা আপনাকে একবারে বিষ খাইয়ে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করছেন না। তারা আপনাকে হত্যা করছেন ধীরে ধীরে। এসব বিষ ফল- সবজি- মাছের সঙ্গে শরীরে ঢুকছে। ফুসফুস- পাকস্থলী- কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যান্সার। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, বুঝতে পারছেন না।

আমদানি করা আপেল- আঙ্গুরের অবস্থা তো আরও খারাপ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রায় খাবার অনুপযোগী। পচা খেজুর আমদানি করা হয়।

৫. ঠিক জানি না,সমাজের সর্বস্তরে এমন অবক্ষয়- অনৈতিকতা, এই মাত্রায় আর কোনো দেশে আছে কিনা! ভারত- পাকিস্তান- শ্রীলংকা- নেপাল- ভুটানে নেই। যত দূর জানি মিয়ানমারের অবস্থাও এমন নয়। থাইল্যান্ড- মালয়েশিয়া- সিঙ্গাপুর- দক্ষিণ কোরিয়া- জাপান কোনো দেশের মানুষ খাদ্যে ভেজাল বা বিষ মেশানোর কথা চিন্তা করতে পারে না।

ইউরোপ- উত্তর আমেরিকায় ফল বা খাবারে ভেজাল বা বিষের কথা কল্পনাও করা যায় না। দক্ষিণ আফ্রিকায় দিনে দুপুরে ছিনতাইকারীরা মানুষ হত্যা করে মাঝেমধ্যেই। কিন্তু প্রকৃতির ফলে বা খাবারে তারা বিষ মেশায় না। ল্যাটিন আমেরিকার মেক্সিকো, ব্রাজিলের কথা জানি, তাদের সমাজও এমন নয়। এর বাইরের পৃথিবী নিজে সরাসরি দেখিনি। খোঁজ নিয়ে যতটা জেনেছি, খাবারে বিষের মত অনৈতিকতার এমন তথ্য কোথাও পাইনি। কোনো জরিপ হলে, খাবারে ভেজাল বা বিষ মেশানোর মানদণ্ডে, পৃথিবীতে বাংলাদেশই কী প্রথম স্থান অধিকার করবে?

৬. ছোট দোকানিরা তো বটেই, সুপার শপগুলোও মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার বিক্রি করে।  বোতলজাত পানির কোনোটাতেই যেসব উপাদান থাকার কথা লেখা থাকে, তা বাস্তবে থাকে না। মোটা ইরি চাল মেশিনে সরু করে কেটে, মিনিকেট নামে বেশি দামে বিক্রি হয়। মিনিকেট নামে কোনো ধান বা চাল নেই। প্রকাশ্যেই এমন প্রতারণা চলছে। লাল চালের চাহিদা বাড়ছে। সাদা চালকে রঙ করে লাল করা হচ্ছে। দুধে শুধু পানি নয়, শ্যাম্পু জাতীয় নানা কিছু মেশানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘি নামে বাজারে যা বিক্রি হয়, তার সঙ্গে আর যাই হোক ঘি’র কোনো সম্পর্ক থাকে না- দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া।

প্রতারণা- অনৈতিকতা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে।

একদিকে খাবারে ভেজাল বা বিষ দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে, আরেক দিকে ভেজাল বিরোধী অভিযানের নামে মানুষের সঙ্গে রসিকতা করা হচ্ছে। সারা বছর খবর নেই, অভিযান রমজান মাসে। উৎসমুখে ব্যবস্থা না নিয়ে, অভিযান খুচরো বিক্রেতা পর্যায়ে। সবচেয়ে বড় ইয়াবা সম্রাট বা গডফাদারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে টিকিয়ে রেখে, ছোট ছোট চোরাচালানিদের বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হচ্ছে। বিমানবন্দর, সমুদ্র বন্দর দিয়ে অবৈধভাবে মোবাইল ফোন সেট দেশে ঢুকছে অবাধে। অভিযান চালানো হচ্ছে বসুন্ধরা সিটি বা আরও কোনো মার্কেটে। উৎসমুখে সুযোগ অবারিত রেখে, ১০টি ফোন সেট যিনি বিক্রি করছেন- অভিযান তার বিরুদ্ধে।

রাতের ঢাকায় মহিষ দেখতে পাবেন। সকালের বাজারে মহিষের মাংস পাবেন না, সব গরুর মাংস। সব বকরির মাংসই এদেশে খাসির মাংস হয়ে যায়। সাদা বা অন্য রঙের খাসি তুলনামূলকভাবে রোগা দেখায়, কালো খাসির চেয়ে। হাট থেকে কালো খাসি কিনে এনে দেখা গেল, সাদা খাসিকে রঙ করে কালো বানানো হয়েছে- গ্রামে নিজেই তা প্রত্যক্ষ করেছি। এক কেজি খেজুর রসের পাটালির দাম ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। এক কেজি চিনির দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা। যে খেজুরের রসে ৫ কেজি পাটালি হওয়ার কথা, তার সঙ্গে ৫ কেজি চিনি মিশিয়ে ১০ কেজি পাটালি তৈরি করা হয়। নিজে দেখেছি এবং বাংলাদেশের সর্বত্র এমনটা চলছে।

অসত্য- অন্যায়- অনৈতিকতা, অপরাধ প্রবণতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। আইনের শাসনহীন দেশের দৃষ্টান্তে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ।

হাত বা পায়ে পচন ধরলে, তার চিকিৎসা আছে। অপারেশনে একটি হাত কেটে ফেললেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারেন। পচন যদি মাথায় ধরে, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা - অসম্ভবে পরিণত হয়। এই রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের মানুষের পচনটা ধরেছে মাথায়।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago